ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচন নিয়ে যেসব জরিপ প্রকাশিত হয়েছে, তার সবগুলোতেই হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির আবারও ক্ষমতায় আসার আভাস দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে দলটি।
এমন পূর্বাভাসের পরও নিজের কুরসি ধরে রাখতে কোনো কিছুতেই ফাঁক রাখছেন না মোদি। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে দেড় দশকের পুরোনো শত্রু ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে ‘মিত্র’ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশটির গণমাধ্যমগুলো একে আরেক মেয়াদে মোদির ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে এই উদ্যোগকে ‘উপহাস’ আখ্যা দিয়েছে কংগ্রেস।
মোদির ‘মিত্র’ সম্বোধনে আলোচনায় ‘শত্রু’ নবীন
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি ওড়িশায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন করে শত্রু নবীন পট্টনায়েককে ‘মিত্র’ বলে সম্বোধন করেন। একই অনুষ্ঠানে নবীন পট্টনায়েকও মোদির নেতৃত্বের প্রশংসা করে ভোটের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দেন।
পূর্ব ভারতের রাজ্য ওড়িশার বিধানসভায় প্রধান বিরোধীদল বিজেপি। যাদের সঙ্গে রাজ্যের আড়াই দশক ক্ষমতায় থাকা দল বিজু জনতা দলের (বিজেডি) সম্পর্ক ‘আদায়-কাঁচকলায়’। ২০০৯ সালে মিত্র থেকে হঠাৎ শত্রু হয়ে যাওয়া বিজেডি আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিজেপিকে বিন্দু পরিমাণও ছাড় দেয় না। স্থানীয় কিংবা জাতীয় যে কোনো ইস্যুতে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা নিত্যদিনের ঘটনা।
নবীন পট্টনায়েকের নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে জনতা দল ভেঙে জন্ম নেওয়া বিজেডি ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিল বিজেপির রাজনৈতিক মিত্র। সেই মিত্রতার খাতিরে নতুন দলের বয়স মাত্র তিন মাস হতে না হতেই অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের ইস্পাত ও খনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান নবীন। তবে ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগি নিয়ে মতভেদে ছেদ পড়ে বিজেপি-বিজেডির বন্ধুত্বে। সেই থেকে কোনও রাজনৈতিক জোটে না গিয়ে একাই চলছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী।
নবীন পট্টনায়েকের বাবা ছিলেন কংগ্রেস নেতা
বিজু পট্টনায়েক নবীন পট্টনায়েকের বাবা। এক সময় তিনি ছিলেন গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠদের একজন। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বের সময় বিজু ছিলেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা। কিন্তু ইন্দিরার সঙ্গে মতবিরোধে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ১৯৮৯ সালে তিনি যোগ দেন জনতা দলে।
বিজেপি-বিজেডি অতীত সম্পর্ক
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৭ সালে নবীন পট্টনায়েক তৈরি করেন নতুন দল বিজেডি। এরপর থেকেই বিজেপির সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১০ আসন জেতা বিজেডি যোগ দেয় বিজেপি সরকারে। সেই জোট ২০০০ এবং ২০০৪ সালের ওড়িশা বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে নেয়। তবে ২০০৮ সালে তৈরি হওয়া মতভেদে ভেঙে যায় বিজেপি-বিজেডি জোট। কারণে ২০০৯ সালের পর থেকে লোকসভা ও ওড়িশা বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে তারা।
‘জয় শ্রী রাম’ বনাম ‘জয় জগন্নাথ’ স্লোগান
গত প্রায় দেড় দশক ধরে বিজেপির ‘জয় শ্রী রাম’ রাজনৈতিক স্লোগানের বিরুদ্ধে ‘জয় জগন্নাথ’ স্লোগান দিয়ে লড়াই করে আসছেন নবীন পট্টনায়েক। টানা ২৪ বছর মুখ্যমন্ত্রীর আসনে থাকা সেই ৭৭ বছরের নবীন এবার কী করেন সেই প্রশ্ন অনেকের।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক ডেকান হেরাল্ড জানিয়েছে, এতদিন বিজেপির কড়া হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে আরও কড়া হিন্দুত্ববাদী স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আছেন নবীন পট্টনায়েক। এবার যদি তারা এক হয়ে নির্বাচনে আসে, তাহলে দেখার বিষয় হবে ফলাফলের পাশাপাশি বিজেপি-বিজেডি জোট কতটা টেকসই হয়।
সবশেষ লোকসভা নির্বাচন
ওড়িশায় ২০১৯ সালে সবশেষ লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গেই হয়েছিল। সেই নির্বাচনে রাজ্যে লোকসভার ২১টি আসনের মধ্যে ১২টি আসনে জেতে বিজেডি ও ৮টি আসনে জেতে বিজেপি। আর ১৪৭ আসনের বিধানসভায় ১১৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিজেডি। মাত্র ২৩টি আসন পেয়ে বিরোধীদলের আসনে বসে বিজেপি।
মোদির লক্ষ্য বিরোধীশূন্য ওড়িশা
বর্তমান লোকসভায় বিজেডি ও বিজেপির বাইরে কংগ্রেসের মাত্র একটি আসন রয়েছে। বিধানসভায় এই দুই দলের বাইরে কংগ্রেসসহ অন্য দলের সদস্য সংখ্যা সাতজন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ওড়িশায় বিজেডি-বিজেপি জোট হলে কার্যত রাজ্যে বিরোধীদল বলে কিছু থাকবে না। তাদের ধারণা, সেই পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাজনৈতিক ‘উপহাস’
নরেন্দ্র মোদি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে মিত্র বলার পর একে ‘রাজনৈতিক উপহাস’ বলে মন্তব্য করেছে কংগ্রেস।
ওড়িশার কংগ্রেস প্রধান অজয় কুমার নিউজ এইটটিনকে জানিয়েছেন, বিজেডি এখন আর আলাদা দল নয়, তারা বিজেপিতে পরিণত হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উপহাস ছাড়া কিছু নয়।