সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুর ব্যবসায়ীরা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। সরকার তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সিসি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশ দিয়েছে। শহরে ইসলামী বিদ্রোহীদের ওপর নজরদারি বাড়াতেই এমন নির্দেশেনা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের নির্দেশ মেনে সিসি ক্যামেরা বসালে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আল-শাবাবের গুলিতে তাদের প্রাণ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। আবার ক্যামেরা না বসালে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে।
বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মোগাদিসুর ব্যবসায়ীদের এই উভয় সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে।
৪৮ বছর বয়সী সাবেক দোকানদার হামজা নূর (ছদ্মনাম) বলেন, “সিসি ক্যামেরার কারণেই আপনি আমাকে এখন বাড়িতে দেখছেন।” সোফায় বসে সন্তানকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
হামজা জানান, তিনি তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়েছেন। তার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল বেদনাদায়ক। এছাড়া আর কোনও উপায় তার ছিল না। তিনি কোনো পক্ষের ক্ষোভের শিকার হতে চাননি।
হামজা নূর বলেন, “একপক্ষ বলে ক্যামেরা সরাতে পারবে না, আর অন্যপক্ষ বলে ক্যামেরা সরাতে হবে। যেটাই করো, হয় গুলি, নয় জেলখানা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
সরকার গত বছর ব্যবসায়ীদের নিজ খরচে সিসি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশ দেয়। উদ্দেশ্য ছিল আল-শাবাবের হামলা প্রতিরোধ করা।
মোগাদিসুর ডেপুটি মেয়র মোহাম্মদ আহমেদ দিরিয়ে বিবিসি আফ্রিকার ডেইলি পডকাস্টে জানান, এই সিদ্ধান্ত সফল হয়েছে।
তিনি বলেন, “আগে মোগাদিসুতে প্রতি মাসে চার-পাঁচটি বোমা হামলা হতো। এখন তা ঘটে না।”
সরকার এখন বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের বাইরেও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশ দিয়েছে। তবে এতে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে, এ কারণে আল-শাবাব তাদের বাড়িঘরেও হামলা চালাতে পারে।
গত অক্টোবর থেকে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিরুদ্ধে আল-শাবাব ১০ বার হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত চারজন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এই তথ্য দিয়েছে সহিংসতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা (অ্যাক্লেড)।
সরকারের এই নির্দেশনার উদ্দেশ্য ছিল আল-শাবাবের অর্থের উৎস বাধাগ্রস্ত করা। কারণ তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে।
অ্যাক্লেড তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিদ্রোহীদের প্রতিশোধমূলক হামলার কারণে মোগাদিসুর প্রধান বাজারগুলোর অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কয়েক দিনের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে।
হামজা নূর জানান, শুরুতে তিনি সরকারের এই নির্দেশনা উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা চাপের মুখে তাকে ক্যামেরা বসাতে বাধ্য করে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, আমি গরীব মানুষ। সরকারের সঙ্গে জড়াতে চাই না। কিন্তু তারা রাগান্বিত হয়ে আমাকে হুমকি দিতে শুরু করল। তারা বলল, আমার জীবন ধ্বংস করে দেবে।
“সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর পর থেকেই অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করে। আমার শরীরের ভেতর থেকে কাঁপুনি শুরু হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কারা ফোন করছে।” তার ইঙ্গিত ছিল আল-শাবাবের দিকে।
নূর জানান, তিনি নিজের ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন। তবে একদিন সকালে এক যুবক তার দোকানে এসে হাজির হয়।
“সে তার গায়ের শার্ট তুলে ধরে তার কোমরে থাকা পিস্তলটি দেখিয়ে আমাকে আমার পুরনো সিম কার্ড চালুর নির্দেশ দেয়। পুরনো মিস চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটি বেজে ওঠে। অচেনা এক ব্যক্তি জানতে চাইলেন, সরকারের দাবি কি আমাদের দাবির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
নূর বলেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। ফোনে কথা বলার সময় পিস্তলধারী যুবকটিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ভাবছিলাম, ফোনটা কেটে দেওয়ার পর হয়ত সে আমাকে গুলি করবে। তাই চুপচাপ মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম।”
নূর জানান, সৌভাগ্যক্রমে ওই যুবক ফোন কেটে দেওয়ার পর কোনো ঘটনা ছাড়াই দোকান থেকে বেরিয়ে যান।
অক্টোবরে দুই ব্যবসায়ী গুলিতে নিহত হওয়ার পর হামজা তার ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তার কাছে প্রাণের চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কিছু ছিল না।
সরকারের নির্দেশনার সমালোচনা করে নূর আরও বলেন, “যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের এমন একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে টেনে নেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকার নিজেই তাদের মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কীভাবে এই পরিস্থিতি সামলাবে, সেটা একবার ভাবুনতো।”
দিরিয়ে নামের আরেক ব্যবসায়ী অবশ্য অস্বীকার করেন যে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা মালিকদের সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনে বাধ্য করা হচ্ছে। অবশ্য কিছু ব্যবসায়ী ভয় পাচ্ছেন তা তিনি স্বীকার করেন।
তবে তিনি বলেন, “সরকার তাদের আশ্বস্ত করতে ও সুরক্ষা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। শহর শান্ত আছে। ব্যবসা স্বাভাবিকভাবে চলছে।”
আসিও মোহাম্মদ ওয়ারসামে নামের আরেক ব্যবসায়ী বিবিসিকে জানান, অক্টোবরে মোগাদিসুর ইয়াকশিদ জেলায় তার ভাই দাহির মোহাম্মদ ওয়ারসামে (৪০) দোকানে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন। এর পরপরই মুখোশধারী বন্দুকধারীরা তাকে হত্যা করে।
ইসমাইল হাসি নামে ৩৩ বছর বয়সী আরেক ব্যবসায়ী জানান, সন্দেহভাজন আল-শাবাব সদস্যদের কাছ থেকে বেনামে ফোন পাওয়ার পর তিনি তার ব্যবসা বন্ধ করে দেন।
তিনি বলেন, “তারা আমার নাম ছাড়াও আরও অনেক কিছু জানত। মনে হচ্ছিল যেন তারা আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানে।”
ইসমাইল জানান, পরে পুলিশ তাকে ফোন করে দোকান খোলার নির্দেশ দেয়। তিনি তা উপেক্ষা করলে তাকে কয়েকদিন জেলে আটক রেখে পরে মুক্তি দেওয়া হয়।
এখন ব্যবসা আবার চালু করেছেন জানিয়ে ইসমাইল বলেন, “সরকারের নির্দেশে সিসি ক্যামেরা এখনও বসানো আছে। কিন্তু আমি জানি, যদি কেউ আমার জীবন নিতে চায়, সরকার আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
“আমি যখন দোকানের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি তখন যতবার অচেনা কেউ দোকানে ঢোকে ততবারই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। ভাবি, একেই কি আমাকে হত্যার জন্য পাঠানো হয়েছে।”
মোগাদিসুর ওয়াজির জেলার বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী সিদো আবদুল্লাহি মোহাম্মদ বিবিসিকে জানান, তার বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা না বসানোর কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি জানান, তার এলাকার আরও ১৪ জন একই কারণে গ্রেপ্তার হন।
মোহাম্মদ বলেন, “আমাদের ওয়াদাজির থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে একজন সরকারি ব্যক্তি এসে আমাদের পক্ষে কথা বললে, আমরা মুক্তি পাই।”
তিনি জানান, এখন তিনি এবং তার এলাকার বাসিন্দারাও বাড়িতে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন। কিন্তু তারা প্রতিদিনই আতঙ্কে থাকেন।
“আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের ক্যামেরা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরপর নিজের খরচে সেগুলো বসাতে হচ্ছে, আর আল শাবাবের হামলার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। সরকার কি এভাবেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায়?” প্রশ্ন মোহাম্মদের।