সরকারের পতন যেদিন ঘটল, তার পরদিন থেকে প্রায় প্রতিদিনই সংঘর্ষ চলছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে; মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই সংঘর্ষে দেখা যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। দুজন মারাও গেছে এর মধ্যে।
সংঘর্ষের সময় কারও হাতে পিস্তল, কারও হাতে শটগান দেখার কথা জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। সোশাল মিডিয়ায় আসা কিছু ভিডিওতেও তা দেখা গেছে।
আটকে পড়া পাকিস্তানিদের এই ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ তারা সেখানে আগেও দেখেছেন, কিন্তু এমন অত্যাধুনিক অস্ত্র তারা আগে দেখেননি।
তাহলে এই অস্ত্র হঠাৎ এল কোত্থেকে? ক্যাম্পবাসীদের ধারণা, গত ৫ আগস্ট থানা লুটের অস্ত্র এসেছে এই সংঘর্ষকারীদের হাতে। পুলিশ সদস্যদের কথায়ও তার সায় মিলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সরকারশূন্য অবস্থায় লুটপাট চলে থানাগুলোতে, খোয়া যায় অনেক অস্ত্র ও গুলি। জেনেভা ক্যাম্পের কাছের গণভবনেও চলে লুটপাট।
তারপর গত ৬ আগস্ট থেকে প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে মাদক কারবারিরা। ৬ আগস্ট সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহেন শাহ নামে এক যুবক মারা যান। মো. সনু নামের আরেক যুবক বুধবার সকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এসব সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক।
যা দেখা যাচ্ছে
“৫ আগস্টের পর থেকে সন্ধ্যা নামলেই প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে বের হয় মাদক ব্যবসায়ীরা। কারও হাতে থাকে পিস্তল, কারও হাতে শটগান। এসব অস্ত্র নিয়ে রাতভর সংঘর্ষ চলে। গুলির শব্দ ও চিৎকার- চেঁচামেচিতে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা,” এভাবেই সাম্প্রতিক চিত্র তুলে ধরেছিলেন তাহির সিদ্দিকী নামে এক ব্যক্তি। গত ৩৫ বছর ধরে জেনেভা ক্যাম্পের পাশে বসবাস করেন তিনি।
তাহির সিদ্দিকী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছুদিন আগেও এই মাদক ব্যবসায়ীরা ধারাল অস্ত্র হাতে মারামারি করত। এতে তারা নিজেরা নিজেরাই আহত-নিহত হত। কিন্তু এখন দুই পক্ষ গোলাগুলি করে। তাদের গুলিতে আহত-নিহত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গুলির ভয়ে এখন মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ভয়ে শিশুদেরও ঘর থেকে বের হতে দেন না অভিভাবকরা।”
তিনি বলেন, “মাদক কারবারিদের এসব কর্মকাণ্ডের ছবি তোলা বা ভিডিও করারও সুযোগ নেই। কারণ সংঘর্ষের সময় কারও হাতে মোবাইল দেখলেই কেড়ে নেয়, মারধর করে মাদক ব্যবসায়ীরা। গত মঙ্গলবারই স্থানীয় এনএলজে স্কুলের শিক্ষক সানিকে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। ছবি তোলার অপরাধে সকালে নাস্তা করতে বের হলে সোহেলের ভাই রানা সানিকে কুপিয়ে আহত করেছেন। কিন্তু এত হামলা হলেও তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার সাহস পায় না কেউ।”
রাজু নামে জেনেভা ক্যাম্পের এক যুবক বলেন, “ক্যাম্পের বেশিরভাগ মানুষ নিরীহ প্রকৃতির। অথচ কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে পুরো ক্যাম্পের দুর্নাম হচ্ছে। তাই খুব দ্রুত এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের নির্মূল করা হোক। এই ক্যাম্পে একটা সেনা অভিযান খুবই প্রয়োজন।”
সাব্বির আহমেদ নামে এক রেস্তোরাঁ কর্মী বলেন, “ক্যাম্পের শিশুরা মাদক দেখে দেখেই বড় হয়। এতে পরবর্তীকালে তারাও মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। তারা মাদকে আসক্ত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসাতেও জড়িয়ে পড়ে। তাই মাদক নির্মূলে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্যাম্পে একটা চিরুনী অভিযান খুবই জরুরি।”
সংঘর্ষে কারা কেন
জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী ৪০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে প্রায় হাজারখানেক মাদক কারবারে জড়িত, একথা বলছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারাই।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এদের মধ্যে অন্যতম ভুঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। তার বিরুদ্ধে ৬০টিরও বেশি মাদক মামলা রয়েছে। সোহেলের সঙ্গে রয়েছে তার ভাই রানা ও টুনটুন।
“তাদের মূলত হেরোইনের ব্যবসা। ইয়াবার জায়গা দখল করে সেখানে হেরোইনের রাজত্ব গড়েছেন সোহেলরা। তাদের সেই রাজত্ব ভাঙতে চান চুয়া সেলিম। ক্যাম্পে গড়ে তুলতে চান ইয়াবার সাম্রাজ্য। “
“মূলত ইয়াবা ও হেরোইন কারবারিদের এই দ্বন্দ্বেই একের পর এক সংঘাত হচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পে,” বলেন তিনি।
ওয়ারেস ইসলাম নামে ক্যাম্পের এক বাসিন্দা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেনেভা ক্যাম্পের ডি ব্লকের ইমাম বারার সামনে আগে ইয়াবা বিক্রি হতো। সেটার নিয়ন্ত্রণ ছিল চুয়া সেলিমের হাতে।
“এখন সেই স্পটে হেরোইন বিক্রি শুরু করেছেন বুনিয়া সোহেল। মূলত মাদকের এই স্পট নিয়েই গত ৬ আগস্ট থেকে দ্বন্দ্বের শুরু। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সংঘর্ষ চলছে।”
থানা থেকে কত অস্ত্র লুট হয়েছিল
গত ৫ আগস্ট বেলা ৩টার পরই হামলা ও লুটপাট শুরু হয় মোহাম্মদপুর থানায়। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে গিয়েও লুটপাট চলতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি গত ৫ আগস্টের আগে থেকেই এখানে কর্মরত। ওইদিন দুপুরের পর আমরা সবাই ফাঁড়ি ছেড়ে থানায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে বিকালের দিকে হাজার হাজার মানুষ থানায় হামলা চালালে জীবন রক্ষায় পালিয়ে যাই।
“ওই হামলার সময় লুটপাটকারীদের বেশিরভাগই জেনেভা ক্যাম্পের। কারণ থানার অস্ত্রাগার ভাঙার মতো যন্ত্রপাতি সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। অন্যদিকে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কারিগরি কাজে দক্ষ। তাই তাদের কাছে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট থাকে। ৫ আগস্ট তারা সেসব ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসে থানার অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে লুটপাট চালায়।”
পুলিশ জানিয়েছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে শুধু মোহাম্মদপুর থানা থেকেই ৭ শতাধিক অস্ত্র ও প্রায় ৩৫ হাজার গোলাবারুদ লুট হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি অস্ত্র ছিল ২ শতাধিক ও গোলাবারুদ ছিল ১৫ হাজার।
এছাড়া বেসরকারি লোকজনের জমা রাখা লাইসেন্সকৃত অস্ত্র ছিল প্রায় সাড়ে ৫০০ এবং গোলাবারুদের পরিমাণ ছিল ১৮-২০ হাজার।
বর্তমানে মোহাম্মদপুর থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা এসআই সাদেক বৃহস্পতিবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, লুট হওয়া সরকারি অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯০টির মতো উদ্ধার হয়েছে। অন্যদিকে থানা থেকে লুট হওয়া বেসরকারি মানুষের অস্ত্রগুলোর একটিও উদ্ধার হয়নি।
তিনি জানান, সরকারি অস্ত্রগুলোর মধ্যে এখনও ৭০টির বেশি পিস্তল, ১৪টি শটগান ও ১টি এলএমজি উদ্ধার হয়নি। এছাড়া লুট হওয়া সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৫০ হাজার গোলাবারুদের কিছুই পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশে বিভিন্ন থানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২টি গুলি লুট হয়েছে ওই সময়ে।
এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র এবং ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮২টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ২ হাজার ৬৬টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি গুলি পাওয়া যায়নি এখনও।
এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে চীনা রাইফেল, এসএমজি, পিস্তল, শটগান, টিয়ারগ্যাস লঞ্চার ও সিগন্যাল পিস্তল।
উদ্ধার হবে কি
থানা থেকে লুট হওয়া জেনেভা ক্যাম্পের মাদক বিক্রেতাদের হাতে থাকার তথ্য জানা থাকলেও লোকবল স্বল্পতার কারণে উদ্ধার করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে খুব শিগগিরই যৌথবাহিনীর সহায়তায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের কিছু জেনেভা ক্যাম্পে আছে বলে আমরাও শুনেছি। কিন্তু জেনেভা ক্যাম্পে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো লোকবল এই মুহূর্তে মোহাম্মদপুর থানায় নেই।
“তবে আশা করি, খুব শিগগিরই আমরা যৌথবাহিনীর সহায়তরায় অভিযান চালাতে পারব,” বলার পাশাপাশি তিনি এই বিষয়ে কোন তথ্য থাকলে তাও জানাতে অনুরোধ করেন।
ক্যাম্পে সংঘর্ষের বিষয়ে তিনি বলেন, “সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুর ঘটনা শুনেছি। তবে এখনও কেউ থানায় অভিযোগ দেয়নি। তাই বিস্তারিত এখনও জানি না।”