বন্দরে জাহাজ থেকে তেল খালাসের দুটি অয়েল ট্যাংকারে অগ্নিকাণ্ডের পর আবার সামনে এলো পাইপলাইনের প্রসঙ্গটি, যা ৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মাণের পর এখন অকার্যকর হয়ে আছে।
১১০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের সঙ্গে সাগরে ভাসমান সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) এবং কক্সবাজারের মহেশখালীর উপকূলে জ্বালানি তেল রাখার স্টোরেজও নির্মাণ করা হয়েছে।
এসব কাজ শেষ করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকদফায় পরীক্ষামূলক তেল পরিবহনও হয়েছে। কিন্তু কে এই তেল পরিবহন করবে, সেই ঠিকাদার নিয়োগ জটিলতায় আটকে আছে পাইপলাইনে তেল খালাস।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মুলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন বাতিলের পর এই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
নতুন নিয়মে এখন সরকারি ক্রয় নীতি অনুযায়ী দরপত্র ডেকে আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে সরকারকে। ফলে কবে নাগাদ সেই প্রক্রিয়া শেষ করে পাইপলাইনে তেল খালাস হবে, তার সুনির্দিষ্ট সময় জানাতে পারছে না বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিপিসি)।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের পুরোটাই আমদানি হয় সাগরপথে সরকারিভাবে, তা করে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। তেলবাহী বড় জাহাজ মহেশখালীর গভীর সাগরে নোঙর করে। এরপর ছোট ট্যাংকারে করে তেল আনা হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ঘাটে।
মহেশখালী থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত তেল পরিবহনের এই কাজটি করে শিপিং কর্পোরেশন, তাদের ট্যাংকার দিয়ে। পুরনো দুটি ট্যাংকার ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’কে তারা এই কাজে ব্যবহার করত। সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের পর দুটি ট্যাংকারই এখন অচল। সেজন্য বিপিসি একটি ট্যাংকার বিদেশ থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।
অথচ পাইপলাইনে এই তেল খালাস হলে ট্যাংকারের প্রয়োজনই হতো না। তা না হওয়ায় এখন দুই খাতেই সরকারকে ব্যয় টানতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে, ট্যাংকার দিয়ে পরিবহনে প্রতি মাসে ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আবার পাইপলাইন স্থাপনের এসপিমএম প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে এসপিএম প্রকল্প পরিচালক ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরীফ হাসনাত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডিসেম্বর এবং সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। আর নির্মাণকাজ শেষে এসপিএম প্রকল্পটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
কাজ বুঝে দেওয়ার পর গত ৮ আগস্ট চীনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন বাকি আছে পাইপলাইনে তেল পরিবহনে ঠিকাদার নিয়োগ করা। সেই কাজটি করবে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঠিকাদার নিয়োগ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশনের (পিপিআর) এর আওতায় উন্মুক্ত দরপত্র ডাকতে হলেও এই কাজে দেরি এড়াতে চায় বিপিসি।
সংস্থার পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ দ্রুততার সাথে ঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টা করব। কিন্তু পিপিআর রুলসে আগের মতো বিশেষ বিধান ২০১০ অনুযায়ী কম সময়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে না।”
ইতোমধ্যেই ঠিকাদার নিয়োগে বিশেষজ্ঞ মতামত চেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “মতামত পাওয়া গেলে লিমিটেড টেন্ডারের মাধ্যমে দ্রুত সময়ে নিয়োগ করা যাবে। সেটি যদি না হয়, তাহলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করতে হবে, যাতে সময় একটু বেশি লাগবে।”
তার মতে, বাংলাদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে, মুলত সেজন্যই বাড়তি সময় লাগবে।
সেজন্য কত সময় লাগবে, সে সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি অনুপম বড়ুয়া। তবে বিপিসির এক কর্মকর্তা জানালেন, পিপিআর রুলস অনুযায়ী ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ শুরু করতে অবশ্যই আট মাস সময় লাগবে। কারণ ধাপে ধাপে যে সময় রুলসে দেওয়া আছে, সেটি চাইলেই কমিয়ে আনা সম্ভব না।
ফলে সেই সময় পর্যন্ত অয়েল ট্যাংকার দিয়েই তেল খালাস করতে হবে। বিএসসির দুটি ট্যাংকার সচল থাকলে তাতে সমস্যা হতো না। কিন্তু সেগুলো অচল হয়ে আরেক সমস্যা তৈরি করেছে বিপিসির জন্য।
কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি চাইলেই জ্বালানি তেল পরিবহনের ঠিকাদার হিসাবে আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসসিকে বাদ দিতে পারছে না। কারণ তাদের সাথে বছরভিত্তিক জ্বালানি তেল পরিবহনের চুক্তি আছে।
বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, পুরনো জাহাজ বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি ভেঙে ফেলা হবে। আর বিপিসির জ্বালানি তেল পরিবহন সচল রাখতে একটি ৩০ হাজার টন ক্ষমতার ট্যাংকার জাহাজ ভাড়ায় বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে।
পাইপলাইনে তেল পরিবহনের সুফল
কর্তৃপক্ষ বলছে, পাইপলাইনে তেল খালাসে তিনটি বড় সুবিধা মিলবে। প্রথমত, সময় সাশ্রয়ী; দ্বিতীয়ত, পরিবহন খরচ ও অপচয় কম; তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তেল খালাস নিরবচ্ছিন্ন থাকা।
বাংলাদেশে আমদানি করা জ্বালানি তেল আনা হয় যে বড় ট্যাংকারে, সেখানে এক লাখ টন তেল থাকে। সেই ট্যাংকার নোঙর করে কেবল মহেশখালীর গভীর সাগরে। কারণ নাব্য সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সাগর থেকে কর্ণফুলী নদী দিয়ে আসতে পারে না।
পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ইস্টার্ন রিফাইনারি, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার তেল মজুদাগার আছে। মজুদাগারের পাশেই আছে ছোট জাহাজ ভেড়ানোর ঘাট। ফলে বড় ট্যাংকার থেকে জ্বালানি তেল স্থানান্তর করে ছোট ছোট জাহাজে তেল মজুদাগারে নেওয়া হয়। এতে সময় বেশি লাগে, পরিবহন খরচ বেশি হয়, তেল পরিবহনে অপচয় হয়, হয় চুরিও।
এই সমস্যা এড়াতে ২০১৫ সালে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প নেয় বিপিসি। চার দফা প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর পর এর ব্যয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। প্রকল্পের সময় শেষ হয় ২০২৪ সালের জুনে; যদিও এখন সময় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে (জি টু জি) চুক্তির ভিত্তিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে মাত্র দুই দিনে প্রায় এক লাখ টন জ্বালানি তেল খালাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবে পাইপলাইন স্থাপনের যৌক্তিকতা দেখিয়ে বলা হয়, বছরে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়, তা সনাতন পদ্ধতির বদলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা গেলে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীর পশ্চিমে সাগরে স্থাপিত হয়েছে একটি ভাসমান মুরিং বা বয়া। ট্যাংকারটি এলে তার সঙ্গে মুরিংয়ের সংযোগ ঘটানো হবে।
এরপর মুরিং থেকে জ্বালানি তেল যাবে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথক দুটি পাইপলাইনে মহেশখালীর কালামারছড়ায় তেল রাখার স্টোরেজে। যেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে অপরিশোধিত তেল থাকবে ১ লাখ ২৫ হাজার টন, বাকি ৭৫ হাজার টন থাকবে ডিজেল।
এই স্টোরেজ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পর্যন্ত সাগরের তলদেশে স্থাপিত হয়েছে ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাশাপাশি থাকা দুটি পৃথক পাইপলাইন। একটিতে পরিবহন হবে ডিজেল, আরেকটিতে অপরিশোধিত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল।
বিপিসি কর্মকর্তারা বলেছেন, মহেশখালীর স্টোরেজ টর্মিনাল থেকে পাম্প করে ৬০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি স্টোরেজে পাঠাতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৭ ঘণ্টা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে একই পরিমাণ তেল ১২ ঘণ্টায় পৌঁছানা সম্ভব।
তারা বলছেন, আর ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার জ্বালানি তেল খালাস করতে সাগর থেকে পতেঙ্গা ডলফিন জেটি পর্যন্ত পৌঁছাতে ২০টি ছোট ট্যাংকারের জাহাজ প্রয়োজন হবে। এই পরিমাণ তেল খালাস করতে স্বাভাবিক সময় লাগতো ৭-৮দিন। ফলে পাইপলাইনে তেল পরিবহনে সিস্টেম লস কমবে, সময়-অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে।