ফিফার ওয়েবসাইটে ফ্যানস ফেবারিট গোল অপশনে এখনও জ্বলজ্বল করছে ম্যাজিকাল চাকমা শিরোনামের ভিডিওটি।
২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী গোল্ডকাপের সেমিফাইনালে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত ভলিতে সেই গোল করেছিলেন মনিকা চাকমা। গোলটি ফিফার সপ্তাহ সেরা গোলের তকমাও পেয়েছিল।
সেই মনিকাকে গড়ে তোলার প্রথম জাদুকর শান্তিমনি চাকমা। শুধু মনিকা নন, জাতীয় দলে আলো ছড়ানো রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, আনাই মগিনিরও প্রথম কোচ শান্তিমনি। গত বছর অবসরে যাওয়া আনুচিং মগিনিও ফুটবল শিখেছেন শান্তিমনির কাছেই।
২০২২ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত মেয়েদের সাফে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলে খেলেছেন এই পাঁচজন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কারও ওঠে রুপনা চাকমার হাতে।
কে এই শান্তিমনি চাকমা
রাঙামাটি কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ফুটবল কোচ শান্তিমনি। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। কিন্তু অভাবের কারণে ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে পারেননি। ৪২ বছর বয়সী এই পুরুষ ফুটবল কোচ নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন তাই ছড়িয়ে দেন অন্যদের মাঝে।
২০১১ সাল। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় মগাছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা শান্তিমনিকে অনুরোধ করেন ফুটবলারদের অনুশীলন করানোর। বীরসেনের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। নিজের সব অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়ে অনুশীলন করান স্কুলের মেয়েদের। ২০১২ সালে স্কুলটি হয় রানার্স আপ। সেই ফুটবল দলেরই পাঁচজন আনাই, আনুচিং, ঋতুপর্ণা, মনিকা ও রুপনা।
আলো ছড়ানোর নেপথ্যে
২০১১ সালে শুরুতে ১৫-১৬ জন ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দিতেন শান্তিমনি। এই মেয়েরা যাতে অন্য কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে না গিয়ে এক জায়গায় থাকতে পারে, সেজন্য সবাইকে ভর্তি করান ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ধাপে ধাপে বাছাই করে আরও অনেক প্রতিভাবান ফুটবলার তুলে আনেন এই কোচ।
রুপনাকে গোলরক্ষক বানানোর পেছনেও বড় অবদান শান্তিমনির। সেই স্মৃতি মনে করে বলছিলেন, “শুরুতে রুপনা মিডফিল্ডে খেলত। কিন্তু ও যেহেতু একটু লম্বা ছিল, তাই গোলকিপার হওয়ার পরামর্শ দিই।”
বর্তমানে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের আবাসিক হোস্টেলে ৪০-৪৫ জন খুদে ফুটবলার অনুশীলন করছে।
মনিকাদের কোচ হয়ে গর্বিত
জাতীয় পর্যায়ে কখনও ফুটবল খেলতে পারেননি শান্তিমনি। কিন্তু যখন দেখেন নিজের হাতে গড়া মেয়েরা দেশ-বিদেশে খেলছে বাংলাদেশের জার্সি পরে, খুশির সীমা থাকে না।
গর্বিত শান্তিমনি চাকমা বলছিলেন, “আমার কল্পনাতেই ছিল না যে ঘাগড়া স্কুলের খানাখন্দ মাঠে খেলা খুদে ফুটবলাররা একদিন দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। টেলিভিশনে যখন ওদের খেলা দেখি গর্ব হয়।”
জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার উঠে এসেছে এই ঘাগড়া স্কুল থেকে। অথচ সেই স্কুলের মেয়েদেরই অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এ নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন কোচ, “এই মেয়েরা ভালো সুযোগ-সুবিধা পায় না। স্কুল থেকে চাউল বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বাকি খাবার সংগ্রহ করতে সমস্যা হয়। নিয়মিত অনুশীলন করলেও ওদের নাস্তাটুকু দিতে পারি না।”
মেয়েরা মূল্যায়ন পেয়েছে এতেই খুশি
সাফজয়ী ফুটবলার মনিকা, ঋতুপর্ণাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন। এটা দেখেই খুশি শান্তিমনি। তাদের যে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট এই কোচ।
দূর পাহাড়ের ফিনিক্স পাখি
সমাজের নানা বাধা পেরিয়ে, চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এই মেয়েরা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। অথচ পাহাড়ের প্রান্তিক এই পরিবারগুলোর অভাবের সীমা ছিল না। এদের দুবেলা খাবারের জোগান দিতে হিমশিম খেয়েছেন কোচ শান্তিমনি, ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান ও মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা।
তা দেখে অনেকেই মনে করেন, আসলে তৃণমূলের এই কোচেরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই হয়ত পাহাড়ি ফুলগুলোর সুরভি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।