চাঁদে মানুষের পা পড়েছে ৫৫ বছর আগে। সেই পদার্পণকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ দেখে আসছে মানবজাতিরই এক সাফল্য হিসেবে। তবে সময় পাল্টেছে। চাঁদ এখন বিবেচিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের, সম্পদের আধার হিসেবে।
চাঁদ নিয়ে ব্যবসা করতে চায়—এমন অন্তত দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। প্রতিষ্ঠান দুটি অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে চাঁদে ভ্রমণে পাঠাতে চায়। অন্যদিকে চাঁদে আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে চীন, ভারত ও রাশিয়া। গত কয়েক বছরে চাঁদকে ঘিরে বেসরকারি-সরকারি দুই ধরনের দৌড়ই বেড়েছে।
চাঁদের কক্ষপথে নভোচারী। প্রতীকী ভিডিও।
এই পরিস্থিতিতে চাঁদের জন্য আলাদা টাইম জোন তৈরি করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের অফিস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি (ওএসটিপি) নাসাকে কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম (এলটিসি) প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদসহ অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের জন্যও নিজস্ব টাইম জোন তৈরির কথা বলেছে হোয়াইট হাউস। কিন্তু তা কেন দরকার?
পৃথিবী থেকে চাঁদ – এক সেকেন্ডের ফারাক
২০ জুলাই, ২০২৪। ওই দিন গ্রিনিচ মান সময় সন্ধ্যা ৮টা ১৭ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে মানুষের চাঁদে অবতরণের ৫৫ বছর পূর্তি। সেই ৫৫ বছরে দিনের সংখ্যা ২০ হাজার ৮৯। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬২টি দিন ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ড করে দীর্ঘ ছিল। বাকি ২৭টি দিন এক সেকেন্ড করে বেশি দীর্ঘ ছিল। কারণ ১৯৭২ সালের পর ২৭ বার বছরের সঙ্গে এক লিপ সেকেন্ড করে যোগ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে সেই ৫৫ বছরে মোট সেকেন্ডের সংখ্যা হবে ১৭৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৯ হাজার ৬২৭।
তবে, এই হিসাবটি চাঁদে রাখা কোনও ঘড়িতে করা হলে ৫৫ বছরে সেকেন্ডের সংখ্যা হবে ১৭৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৯ হাজার ৬২৮। তার মানে এক সেকেন্ড (১.১৭৯২২৪৩ সেকেন্ড) বেশি হবে। চাঁদে পৃথিবীর মহাকর্ষের টান কম থাকায় পৃথিবীর তুলনায় সেখানে সময় দ্রুত চলে। চাঁদে প্রতিদিন পৃথিবীর তুলনায় ৫৮.৭ মাইক্রোসেকেন্ড বেশি সময় অতিবাহিত হয়।
চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর সময়ের এই অতি সামান্য পার্থক্যের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চাঁদের জন্য আলাদা ‘টাইম জোন’ তৈরি করতে চায়। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এর কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে নাও হতে পারে। তবে পৃথিবীর সঙ্গে মহাকাশযানের সময়ের সমন্বয় করার সময় এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রত্যাশা, নতুন সময় চাঁদে পৌঁছানোর জন্য জাতীয় ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাগুলোকে সমন্বিত রাখতে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নাসাসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা আগামী বছরগুলোতে চাঁদে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। কেউ কেউ চাঁদে ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহ করার এবং অনুসন্ধান প্রচেষ্টা প্রসারিত করার আশাও করছে।
ছাব্বিশে আবার
ওএসটিপির ডেপুটি ডিরেক্টর ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টিভ ওয়েলবি এক বিবৃতিতে বলেছেন, হোয়াইট হাউস “নিরাপত্তা ও নির্ভুলতার জন্য” মহাকাশে নিজস্ব সময়ের মান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, মহাকাশযান ভেড়ানো বা অবতরণ করানোর জন্য বর্তমান সিস্টেমের চেয়েও সময়ের আরও বেশি সঠিকতা লাগবে।
নাসা তার আর্টেমিস প্রোগ্রামের অধীনে ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবারও চাঁদে মহাকাশচারীদের পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এই মিশনের লক্ষ্য চাঁদে প্রথম নারী ও অশ্বেতাঙ্গ মানুষ পাঠানো এবং মঙ্গল গ্রহে ভবিষ্যতের মানব অভিযানের প্রস্তুতিতে সহায়তা করা।
আর্টেমিস-৩ ১৯৭২ সালে অ্যাপোলো-১৭ এর পর থেকে চাঁদে যাওয়া প্রথম মানব মিশন হবে। মিশনটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে, যেখানে কখনও সূর্যের আলো পড়েনি এমন কিছু গর্ত রয়েছে। আর সেই গর্তগুলোতে জমাট পানি বা বরফের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই মিশনের অবস্থান নির্ণয় এবং নির্দেশনার জন্য ন্যানোসেকেন্ড পর্যায়েও অত্যন্ত নির্ভুলতা প্রয়োজন। কারণ নেভিগেশনে অতি সামান্য ত্রুটিও মহাকাশযানের ভুল কক্ষপথে প্রবেশের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
নাসার আর্টেমিস-৩ এর পাশাপাশি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চাঁদে মহাকাশযান ও নভোচারী পাঠাবে। তাদের মধ্যে সময়ের সমন্বয় না থাকলে মহাকাশযান, স্যাটেলাইট ও পৃথিবীর মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান এবং যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সময়ের ঘাড়ে মাধ্যাকর্ষণ
মহাকর্ষের তীব্রতা অনুযায়ী মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সময় ধীরে বা দ্রুত চলে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী,মহাকর্ষ হলো বিশাল ভরের কোনও বস্তুর (গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদির) উপস্থিতিতে স্থান-কালের (স্পেস-টাইম) বক্রতা। কোনও বস্তু আকারে যত বড় হবে তত বেশি এটি তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকাবে। এর ফলে তার চারপাশে সময়ও ধীরগতিতে চলবে। একইভাবে পৃথিবীও তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, যার ফলে পৃথিবীর যত কাছাকাছি যাওয়া যায় সময় তত ধীরগতিতে চলে। চাঁদ পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে পৃথিবীর মহাকর্ষের টান কিছুটা কম। ফলে চাঁদের সময় দ্রুত চলে। তবে এই প্রভাব খুবই সামান্য, যা চোখে পড়ার মতো নয়।
সময়ের ওপর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব ইতোমধ্যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরও অংশ হয়েছে। তবে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি স্যাটেলাইট পজিশনিং সিস্টেমে, যেমন আমেরিকার জিপিএস এবং ইউরোপের গ্যালিলিও, যা প্লেন, গাড়ি,জাহাজ এবং স্মার্টফোনগুলো কোথায় আছে তা বলে দেয়। এই ধরনের সিস্টেমগুলো মহাশূন্যে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পারমাণবিক ঘড়ি স্থাপন করে কাজ করে, যেখান থেকে তারা সময় সংকেত সম্প্রচার করে। পারমাণবিক ঘড়িগুলো পৃথিবী থেকে ২০-২৪ হাজার কিলোমিটার দূরে মহাকাশে থাকায় তারা যে সংকেতগুলো প্রেরণ করে সেগুলোকে আপেক্ষিকতাকে বিবেচনায় নিতে হয়।
পৃথিবীতে সময়ের সঙ্গে স্যাটেলাইট সিগন্যালগুলোর তাল ঠিক রাখার জন্য আবার পৃথিবীতে থাকা পারমাণবিক ঘড়িগুলোর সঙ্গে মহাকাশের ঘড়িগুলোর সময়ের সমন্বয় করা হয়। একে ইউটিসি বা ইউনিভার্সাল টাইম তথা সমন্বিত সার্বজনীন সময় বলা হয় (যা অনেকটা গ্রিনিচ মান সময়ের মতো)। ইউটিসির চূড়ান্ত গ্যারান্টার হল পৃথিবীর চারদিকে স্থাপন করা শত শত পারমাণবিক ঘড়ির রিডিংয়ের গড়। একে বলা হয় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সময় (টিএআই)। এই ঘড়িগুলো ন্যানো সেকেন্ডে সময় গণনা করে, যা ন্যানোসেকেন্ডে সময় রেকর্ড করতে পরমাণুর পরিবর্তনশীল শক্তির অবস্থা পরিমাপ করে। ইউটিসির সঙ্গে সময়ের সমন্বয় করার জন্য এর সঙ্গেও লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদে এর জন্য সম্ভবত চাঁদেও পৃথিবীর মতো পারমাণবিক ঘড়ির একটি নেটওয়ার্ক প্রয়োজন হবে। এর মাধ্যমে চাঁদের জন্যও একটি জিপিএস সিস্টেম স্থাপন করা যাবে। এই ধরনের একটি সিস্টেম নক-অন ইফেক্টে সাহায্য করতে পারে, যা বিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবী ও চাঁদে সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য যেমন আলাদা, তেমনি এক মিটারের দৈর্ঘ্য এবং এক কিলোগ্রামের ভরও আলাদা হবে (এক মিটারকে সংজ্ঞায়িত করা হয় শূন্যস্থানে আলো এক সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তার ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ ভাগের এক ভাগ)।
চাঁদের জন্য একটি সর্বজনীন সময় গণনা পদ্ধতি তৈরি করতে নাসা একা কাজ করছে না। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সিও ভবিষ্যতে চাঁদে অভিযানে সহায়তার জন্য একটি লুনার টাইমজোন তৈরি করছে। তবে একটি নতুন চান্দ্র সময় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রয়োজন হবে। এর জন্য বর্তমানে পৃথিবীতে সময়ের হিসাব রাখা আন্তর্জাতিক ওজন ও পরিমাপ ব্যুরোর মতো একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থাও লাগবে। বিভিন্ন দেশ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থার মধ্যে চুক্তি হতে হবে। অন্তত আর্টেমিস অ্যাকর্ডে অংশগ্রহণকারী ৩৬টি দেশের মধ্যে সমঝোতা হতে হবে। আর্টেমিস অ্যাকর্ড মহাকাশ ও চাঁদে কার্যকলাপের জন্য সার্বজনীন নির্দেশনা দেয়।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, টাইম, দ্য ইকোনমিস্ট