সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর পাঁচ দিনে সারাদেশে দেড় শতাধিক জন নিহত হয়েছে। এরমধ্যে শতাধিক নিহত হয় সান্ধ্য আইন জারি করে সেনাবাহিনী নামানোর আগে তিন দিনে।
নিহতদের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পথচারী, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যও রয়েছে। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার, যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যই হাজারের বেশি।
নিহতদের অধিকাংশ প্রাণ হারিয়েছে ঢাকায় সংঘাতে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে উত্তরা, বাড্ডা-রামপুরা ও যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়ায়। এই তিনটি স্থানেই সংঘাতের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। নিহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ১৯ জুলাই, শুক্রবার। সেদিন অন্তত ৭৫ জন মারা যায়।
গত মাসে হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের রায় দেওয়ার পর এই মাসের শুরুতে রাজপথে আন্দোলনে নামে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ কেন্দ্রিকই ছিল এই আন্দোলন। ধীরে ধীরে তার পরিসর বেড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ে।
গত সোমবার (১৫ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা আক্রান্ত হওয়ার পরদিন মঙ্গলবার সহিংস হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। তাতে ঢাকায় একজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়।
ছয়জনের মৃত্যুর পরদিন বুধবার গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তার আগেই সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সব ছাত্রাবাস খালি করার নির্দেশ দেয়। বুধবার বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ঘটলেও কোনও প্রাণহানি ঘটেনি।
বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক বনধ কর্মসূচি ডাকলে তাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। তাতে অন্তত ৪১ জনের মতো নিহত হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে।
নিহতের বেশিরভাগ ঘটনাই ঢাকা মহানগরীর। এর বাইরে ঢাকার সাভার, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ কয়েকটি জেলা থেকেও প্রাণহানির খবর আসে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও আইনমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দাবি পূরণের আশ্বাসেরও পরও সর্বাত্মক বনধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেবে।
তাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও শুরু হয় সংঘাতের মধ্যদিয়ে। ঢাকার উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দিন শেষে মোট ৭৫ জন নিহত হওয়ার খবর আসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। এরমধ্যে ঢাকার বাইরে ১২ জন, বাকিরা সবাই ঢাকার।
শুক্রবার রাতে সরকার সান্ধ্য আইন জারি এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর শনিবারও ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় সংঘাতে ৩৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢাকা নগরীতে নিহত হয় ১৫ জন। এর বাইরে ঢাকার সাভারে ৪ জন, ময়মনসিংহে ৪ জন, গাজীপুরে ২ জন, নরসিংদীতে ১ জন নিহত হয়।
রবিবারও ঢাকার যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ, বনশ্রী ও কাজীপাড়ায় এবং নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে সংঘর্ষ হয়। তাতে মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭ জন মারা যায় এদিন।
সোমবার আর সংঘাত না ঘটলেও আগে আহত পাঁচজনের মৃত্যু হয় সেদিন।
সব মিলিয়ে ১৬ জুলাই সংঘাত শুরুর পর ছয় দিনে অন্তত ১৮৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এবং চলাচল অবাধ না থাকায় নিহতের তথ্যগুলো যাচাই করা সাংবাদিকদের জন্য ছিল দুষ্কর। আবার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও এক পর্যায়ে নিহতের তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সহিংসতায় মোট তিনজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ১১৭ জন, যার মধ্যে তিনজন গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে আইসিইউতে রয়েছে।
দুই সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন অহিংসই ছিল। তা সহিংসতায় গড়ানোর পর বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনাই হয়ে উঠেছিল হামলার লক্ষ্য।
সেদিন বিকালে মহাখালীতে সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে হামলা এবং আগুন ধরানো হয়। মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়ায় মেট্রো স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রামপুরায় বিটিভি অফিসে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
রামপুরায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দপ্তরসহ সারা ঢাকায় অসংখ্য পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালী ও বনানী প্রান্তের টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তার আগে বুধবার রাতে আগুন দেওয়া হয় যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায়।
নরসিংদীতে কারাগারে হামলা হয়ে, তাতে পালিয়ে যায় আটশ’র বেশি বন্দি। তার মধ্যে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নয়জন সদস্য ছিল বলে কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা এবং অগ্নিসংযোগকারীরা আন্দোলনের আগের মুখ নয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্ররাও বলছেন, এই অগ্নিসংযোগের দায় তারা নেবে না। কারণ তাদের এমন কোনও নির্দেশনা ছিল না।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই হামলা-অগ্নিসংযোগের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে নাশকতা চালাচ্ছে।
শুক্রবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে তিনি বলেন, এই আন্দোলন এখন আর শিক্ষার্থীদের হাতে নেই। তা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে চলে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সোমবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়ে সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে জামায়াত-শিবির। আর পেছন থেকে তাতে মদদ দিয়েছে বিএনপি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিল বিএনপি। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার তারা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। তবে পুলিশে বাধায় পারেনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলটির কয়েকজন নেতাকে পুলিশ আটক করেছে। আটক করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরোয়ারকেও।
২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতা, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুরকেও ঢাকায় তার বাসা থেকে র্যাব তুলে নিয়ে গেছে বলে পরিবার জানিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, সংঘাতের ঘটনায় শতাধিক মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে সহস্রাধিক ব্যক্তিকে।