শৈশবে খেলার মাঠ তাকে ভীষণ টানতো। এক সময় ফুটবল ও ভলিবল খেলেছেন। এমনকি বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলে ইন্টারভিউ বোর্ডে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দেশের সংখ্যা কতটি?” নিমিষেই উত্তরটা দিয়েছিলেন তিনি।
খেলাপাগল সেই মানুষটির নাম মশিউর রহমান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। তবে ক্রীড়া মনটা যেহেতু হারিয়ে যায়নি, তাই খেলা-পাগল মানুষদের জন্য করেছেন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম গেমপ্লিফাই এক্সওয়াইজেড। এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মশিউর নিজেই।
তার তৈরি এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হাজারো ইউজার সহজেই ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, আর্চারি, অ্যাথলেটিকসসহ সব রকমের খেলা নিয়ে আড্ডা দিতে পারেন ভারচুয়াল জগতে। তাছাড়া এই ওয়েবসাইটে ঢুকে সহজেই যে কেউ বিভিন্ন খেলা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবানী (প্রেডিকশান) করে বা কুইজে অংশ নিয়ে জিতে নিতে পারেন আইফোনসহ নানা রকমের আকর্ষণীয় পুরস্কার। অথবা এই প্লাটফর্ম থেকে পাওয়া ক্রেডিট ভাঙিয়ে গেমপ্লিফাই স্টোর থেকে জিতে নিতে পারেন আইফোনসহ বিভিন্ন রকমের রেস্টুরেন্ট প্যাকেজ।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স, লিঙ্কডেনসহ-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা প্লাটফর্ম রয়েছে বিশ্বে। কিন্তু চাইলে সেখানে শুধু খেলাধুলা বিষয়ক আড্ডা, আলোচনা, কুইজ বা অন্য কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ কম। যে কারণে শুধু খেলাধুলাকেন্দ্রিক এমন একটি প্লাটফর্ম তৈরির ভাবনা মাথায় আসে মশিউরের।
এ প্রসঙ্গে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, “গেমপ্লিফাই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম। যেখানে ফেসবুক, এক্সসহ অন্য যোগাযোগমাধ্যমে ইউজারগণ রাজনীতি, বিজ্ঞান, বিনোদন, খেলাধুলাসহ যে কোনও বিষয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু গেমপ্লিফাই শুধু খেলাধুলাকেই ফোকাস করে। ইউজাররা এখানে যুক্ত হতে পারেন। বিনিময় করতে পারেন খেলার বিভিন্ন তথ্য, ছবি। এবং সেই সঙ্গে তারা কিছু গেমসও খেলতে পারবেন।”
খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ থেকেই এমন একটি ক্রীড়াবিষয়ক প্লাটফর্ম তৈরির চিন্তা মশিউরের, “আমি খেলাধুলার ব্যাপারে ভীষণ অনুরাগী। আমি দেখেছি বিশ্বকাপ, অলিম্পিক গেমস বা চ্যাম্পিয়নস লিগ চলার সময় ফেসবুকে মানুষ প্রেডিকশন করে। এসব নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু ফেসবুক আলাদাভাবে ক্যাটাগরাইজড করে বিশেষ কিছু দিতে পারে না। কারণ তাদের সেই ব্যবস্থা নেই। ব্যবহারকারীরা যেসব মতামত দিচ্ছে সেগুলো এক পর্যায়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুক একটা ম্যাচের সঙ্গে সরাসরি লিঙ্কও করতে দেয় না। সোজা কথা খেলার জন্য নিবেদিত এমন প্লাটফর্ম নেই। আমার মনে হয়েছে ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য এমন একটা অপশন থাকা দরকার। যে কারণে আমি এই ওয়েবসাইট তৈরি করেছি।”
মূল কথা ক্রীড়াপ্রেমী বাংলাভাষাভাষীদের এক ছাদের নিচে ভারচুয়ালি আনার পরিকল্পনা মশিউরের। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও দেশের বাইরে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই ওয়েবসাইটে স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ, লোকেশন, ফিল্টারিংসহ আরও অনেক ফিচার আনতে চান তিনি। এসব নিয়ে মশিউর বলেন, “ আমি চাই খেলাধুলার জন্য মানুষের একটা ডেডিকেটেড স্পেস থাকুক। “
কলকাতাসহ অন্য দেশের প্রবাসীরাও ইদানিং যুক্ত হচ্ছেন এখানে। এই ওয়েবসাইটে যে কোনও ভাষায় কনটেন্ট লেখা যায়। আরবি, স্প্যানিশ ও ইংরেজিতে যেটা সরাসরি অনুদিত হয়ে যাবে। এবং যে কোনও ভাষায় সেটা পোস্ট হবে। যদিও পুরো ফিচারগুলো এখনও পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে।
গেমপ্লিফাইয়ের পথচলা শুরু ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে। যদিও তখন খুব কম ইউজার ছিল। তবে ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে বেশ সাড়া মিলতে শুরু করে।
নিজের পেশাগত কাজের বাইরে ওয়েবসাইট সংস্করণ, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের জন্য বেশ সময় দিতে হয়। এজন্য পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ দিলেন মশিউর, “আসলে অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়েছি এটা নিয়ে। নিজের প্যাশন আছে তাই এসব বিষয়ে অনেক কিছু ছাড় দিতে হচ্ছে। এজন্য সময় বের করে নিতে হয় ব্যক্তিগত জীবন থেকে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি এজন্য কৃতজ্ঞ আমি।”
শুধু নিজে ওয়েবসাইট নিয়ে কাজই করেন না, মাঠে গিয়েও ফুটবল উপভোগ করেন মশিউর। গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকার ফাইনালে সরাসরি মাঠে বসে দেখেছেন লিওনেল মেসির কান্না। এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে দেখেছেন ইন্টার মিয়ামিতে মেসির অভিষেক ম্যাচ।
লিগ কাপে মেক্সিকোর বিপক্ষে ক্রুজ আজুলের সঙ্গে ইন্টার মায়ামির ম্যাচে তখন যোগ করা সময়ের খেলা চলছে। খেলায় ১-১ গোলের সমতা। গোল পেতে মরিয়া ইন্টার মায়ামি লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করে একের পর এক আক্রমণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু গোলের দেখা পাচ্ছিল না তারা। এমন সময়ে বক্সের বাইরে মেসিকে ফাউল করেন ক্রুজ আজুলের এক খেলোয়াড়। ফ্রি-কিক নিতে এগিয়ে যান মেসি। ২০ গজ দূর থেকে নেওয়া মেসির বাঁ পায়ের ফ্রি-কিকটি আটকানোর কোনো সুযোগই পাননি ক্রুজ আজুলের গোলকিপার। তাঁর ডান পাশের ওপরের কোনা দিয়ে বল চলে যায় জালে। মেসির ৯৪ মিনিটের এই গোলে ২-১ ব্যবধানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইন্টার মায়ামি।
সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “মাঠে বসে খেলা দেখার মজাই আলাদা। ইন্টার মায়ামিতে ওটা ছিল মেসির প্রথম ম্যাচ। আমি থাকি সিয়াটল। সেখান থেকে মিয়ামিতে যাওয়া খুব কঠিন। উত্তর থেকে দক্ষিণে। খুব কষ্ট করে গিয়েছিলাম। দেখি একাদশে নেই মেসি। শেষ মুহূর্তে তাকে নামান কোচ। একটা পর্যায়ে মেসি ফ্রি কিক নিতে আসেন। ডেভিড বেকহাম ভাবছিলেন গোল হবেই। এবং দেখা গেল তাই। শেষ সময়ে ফ্রি কিকে গোল হলো। কিন্তু সেটা পেনাল্টি ছিল না। অবিশ্বাস্য! আমি সমর্থকদের চোখেমুখে যে আনন্দ উল্লাস দেখেছি তা ছিল অবিশ্বাস্য।”
পরে গেমপ্লিফাইয়ে এসব নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করেন মশিউর।
নিজের সোশ্যাল প্লাটফর্ম নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে মশিউরের, “এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। বাংলাদেশে আরও প্রচার করার ইচ্ছাও আছে। এজন্য এর প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।”
সাধারণ ইউজারকে গেমপ্লিফাই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হলে ওয়েবসাইট দিয়ে ঢুকতে হবে। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ থাকলেও অল্প কিছু পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্মে ঢোকার ঠিকানা www.gameplify.xyz । এরপর সাইন আপ করতে হবে ইউজারকে। সাইন আপ করার সময় নাম ও ফোন নম্বর দিতে হবে। এবং ইউজারকে একটা ইউনিক আইডি ব্যবহার করতে হবে। যা দিয়ে ওই ইউজার লগ ইন করতে পারবেন। এছাড়া ফোন নম্বর বা ইমেল দিয়ে লগ ইন করতে পারবেন। পাসওয়ার্ড নিজেই সেট করতে হবে। সিস্টেমে অংশ নিলে দেখা যাবে কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে বা কোনও ম্যাচে ক্লিক করলে সেখানে ওই ম্যাচের যাবতীয় তথ্য দেখা যাবে।
GAMEPLIFY XYZ: Social Media for Sports Lovers |
ভারচুয়াল বিশ্বে বাংলাভাষাভাষীদের জন্য খেলাধুলা নিয়ে এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।