Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রামে মশা নিধন : মেয়রের মন্তব্যে উঠল অনেক প্রশ্ন 

শনিবার চট্টগ্রামের হালিশহরে মশা নিধনে ‘ক্রাশ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম।
শনিবার চট্টগ্রামের হালিশহরে মশা নিধনে ‘ক্রাশ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম।
[publishpress_authors_box]

“মশা মারতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে তাতে ৪০টি ওয়ার্ডে মশা মরলেও নগরীর একটি এলাকা হালিশহরে মশা মরছে না” —এ মন্তব্য সিটি মেয়র রেজাউল করিমের।

শনিবার হালিশহরে মশা নিধনে ‘ক্রাশ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

সেখানে তিনি ঘোষণা দেন, হালিশহরের মশা মারতে সিটি করপোরেশন ভবনের আটতলায় গবেষণাগার স্থাপন করা হবে, যেখানে সব এলাকার মশার লার্ভা সংগ্রহ করে নমুনা পরীক্ষা করে এরপর মশা মারা শুরু করবেন তিনি।

তার এমন বক্তব্যের পর সিটি করপোরেশনের মশা মারার ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

সব ওয়ার্ডে মশা মারার সুফলের কথা বলা হলেও কোন ওয়ার্ডে মশা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তা জানতে চেয়েছেন অনেকে। তাদের বক্তব্য, ক্রাশ প্রোগাম লোক দেখানো। খাল-নালা পরিষ্কার না করেই মশা মারার কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে, সেখানে তো মশা মরবে না।  

হালিশহরে যা হচ্ছে

চট্টগ্রাম সিটিতে ৪১টি ওয়ার্ড আছে। সব ওয়ার্ডে দুইভাবে মশা মারার কীটনাশক দেওয়া হয়। একটি হচ্ছে স্প্রে করে; আরেকটি ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিয়ে। মশার লার্ভা মারার জন্য কালো তেল, ন্যাফথলিন মিশ্রিত মাস্কুবান ও লার্ভিসাইড ছিটানো হয়। আর বড় মশা মারতে ফগার মেশিনের মাধ্যমে অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগ করা হয়।

প্রশ্ন উঠেছে, ৪১টি ওয়ার্ডে যদি একইভাবে একই ধরনের কীটনাশক ছিটানো হয় তাহলে সব ওয়ার্ডে মশা মরলে হালিশহরে কেন মরবে না?

মেয়র রেজাউলের বলেন, “বিদ্যমান ওষুধের প্রতি কিছু প্রজাতির মশার হয়তো প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার জীবনচক্রও যাচ্ছে বদলে। ফলে সব ওয়ার্ডে মশা মরলেও হালিশহরে মরছে না।”

কীসের ভিত্তিতে মেয়র এই তথ্য দিয়েছেন— প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওষুধে মশা মরছে না, তা নয়। মশা মরছে কিন্তু তার চেয়ে লাখগুণ বেশি মশা তৈরি হচ্ছে সেই এলাকায়। এই কারণেই আমরা হালিশহর এলাকাকে মশার অভয়রাণ্য বলছি।

“সেই অভয়ারণ্য তৈরির প্রধান কারণ হচ্ছে, মহেশখাল ও তার শাখা প্রশাখাগুলোয় এখন পানিপ্রবাহ সচল না থাকা। জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের জন্য এই খালে পানি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কচুরিপানা জমে ভরাট হয়ে আছে। এখন আপনি সেখানে যতই মশার ওষুধ ছিটান, কোনও লাভ নেই। নালাগুলো পরিষ্কার না করা পর্যন্ত আমরা নিজেরা কোনও কাজ করতে পারছি না। ফলে সেখানে দেখে মনে হবে মশার চাষাবাদ হচ্ছে।”

হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ব্যাংকার সোহেল আরেফিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মশা মারার পদ্ধতিতেই ত্রুটি আছে। ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি আছে। বেশ কবছর ধরেই মহেশখাল আবর্জনা, কচুরিপানায় ভর্তি। জোয়ার-ভাটা নেই। ফলে সেখানে মশার কারখানা হবেই।

“আর আপনি খালের একপাশ থেকে কত ফুট দূরে স্প্রে করতে পারবেন? আর কচুরিপানা পরিষ্কার না করে স্প্রে করলে কোনও সুফল মিলবেই না। এতদিন সিটি করপোরেশন সেই জিনিসটাই তো বোঝেনি। তিনবছরের পরিকল্পনা নিয়ে আগালে এতদিনে অনেক সুফল মিলতো।”

মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহির কথা সত্য ধরে নিলে বোঝা যায়, কীটনাশকে মশা মরছে, কিন্তু তা মশা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। অর্থাৎ নালা, খাল পরিষ্কার করেই ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

কিন্তু সেটি না করে ল্যাব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু—এ প্রশ্নের জবাবে মাহি বলেন, “ভবিষ্যতের জন্য আমরা কাজটা এগিয়ে রাখছি।”

ল্যাব স্থাপন করে, নমুনা পরীক্ষা, সরকারি অনুমোদন এরপর কীটনাশক কিনে ছিটাতে গেলে তো অনেক সময় লাগবে, তাই না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কাউকে না কাউকে তো কাজ শুরু করতে হবে।”

গবেষণা প্রতিবেদন কী বলছে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০২১ সালে নগরে মশার প্রজনন এবং মশা মারার কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে একটি গবেষণা করে। জুলাইয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে সেই প্রতিবেদন আগস্টে সিটি করপোরেশনে জমা দেয় গবেষক দলটি।

ছয় সদস্যের গবেষণা দলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া আহ্বায়ক ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক ছিলেন সদস্য সচিব।

দলের অন্য সদস্যরা হলেন, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তাপসী ঘোষ, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এইচ এম আবদুল্লাহ আল মাসুদ, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।

প্রতিবেদনে, নগরীর ৯৯টি এলাকা পরিদর্শন করে ৫১টি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এলাকা থেকে ৬টিসহ মোট ৫৭টি স্পট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ১৫টি স্পটে শতভাগ এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত করে। ১৫টি স্পটের মধ্যে নগরীর হালিশহর এলাকা আছে। ধরে নেওয়া যায়, হালিশহরে একই প্রজাতির মশার বসবাস। নতুন কোনও প্রজাতি এখানে নেই।

গবেষণা প্রতিবেদনে, কোন সময়ে মশা মারতে কীটনাশক প্রয়োগ করলে সুফল মিলবে; ৫ ধরনের কীটনাশকের মধ্যে কোনটা কীভাবে প্রয়োগ করলে কার্যকারিতা কেমন হবে- তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

কোন কীটনাশক কতটা সফল তাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

২০২১ সালের পর ২০২২, ২০২৩ সাল পার হয়েছে, কিন্তু গবেষণা কাজে আসেনি। আগের পদ্ধতি ও একই কীটনাশক প্রয়োগ করেছে সিটি করপোরেশন। ফলে মশার উৎপাত কমেনি, উল্টো মশার কামড়ে মৃত্যু বেড়েছে।

এখন ২০২৪ সালে এসে মেয়র রেজাউল করিম নতুন করে বলছেন, মশা মারতে তিনি গবেষণাগার চালু করবেন।

২০২১ সালের গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ড. রবিউল হাসান ভূইয়া বলেন, “৫টি নমুনা ওষুধ যাচাই করে আমরা একটি ওষুধ পাই, যা প্রাকৃতিক ও শতভাগ মশা মারতে সক্ষম। সেটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেটি ব্যবহার হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। 

“ফগিং করার একটি নিয়ম আছে। সাধারণত সন্ধ্যার সময় যখন মশা খাবারের খোঁজে বের হয়, তখন ফগিং করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় দুপুরে, বিকালেও ফগিং করা হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ায় ফগিং না করায় মশা মরে না। ওষুধ প্রয়োগের ক্ষত্রে ফগিং মেশিন ব্যবহার না করে স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছি আমরা। ফগিং মেশিন দিয়ে এই ওষুধ ছিটালে কার্যকর হবে না।”

হালিশহর এলাকায় ‘বিশেষ প্রজাতির কোনও মশা গবেষণায় পাইনি’ বলেন ড. রবিউল হাসান ভূইয়া।

রবিবার সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “১৫টি স্থানেই আমরা এডিস মশা পেয়েছি। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিউলেক্স মশা পেয়েছি। অন্য কোনও জাতের মশা আমরা পাইনি।”

মহেশখাল এলাকা।

গবেষণাগার চালুর কথা কেন

মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তিনবছর পর এসে মশা মারতে গবেষণাগার স্থাপন করতে চাইছেন রেজাউল করিম।

তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে নতুন করে কীটনাশক কিনে তা প্রয়োগ করতেই মেয়রের মেয়াদ পার হয়ে যাবে বলছেন নগরের অনেকে। তাদের মতে, এটি আসলে মশা মারার আসল কাজটি না করে কাজকে দীর্ঘায়িত করার একটি প্রক্রিয়া।

সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা শফিউল আজম বলেন, “সন্ধ্যা নয়, বিকাল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত কয়েল জ্বালিয়ে মশা থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। তিন বছরে একটি বারের জন্য আমাদের বাসায় দেখলাম না সিটি করপোরেশনের মশা মারার টিম এসেছে।

“ফলে মশা তো মারার প্রক্রিয়াই চলেনি। কার্যকর হয়েছে কি না, সেটি পরের কথা। এখন উনি (মেয়র) ল্যাব বসিয়ে মশা শনাক্ত করে আবার মশা মারবেন। এসব বন্ধ করে আগে ওষুধ ছিটানোর কাজটি সঠিকভাবে তদারকি করে মশা মরে কিনা দেখেন।”

কী বলেছেন সিটি মেয়র

শনিবার মশা নিধনের ক্রাশ কর্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার জীবনচক্রও বদালাচ্ছে। এখন যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তাতে কিছু প্রজাতির মশার হয়তো প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তাই ৪১টি ওয়ার্ডেই নিয়মমাফিক মশা ওষুধ ছিটানোর পরও দেখা যাচ্ছে হালিশহরসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে মশা কমছে না। অথচ একই ওষুধে অন্যান্য এলাকায় মশা মরছে। 

“কেন মশা মরছে না—এজন্য মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় জানতে এপ্রিলের মধ্যে গবেষণার জন্য পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। এটি সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয়ের অষ্টম তলায় চালু করা হবে।”

মেয়র বলেন, “গবেষণাগারে আমরা প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখব। কোন ধরনের ওষুধ কোন ধরনের মশার জন্য কার্যকর, তা জানা যাবে। তখন গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এলাকাভিত্তিক ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম গ্রহণ করবো।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত