২৫ বছর আগে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পান রেজিয়া বেগম। কোল আলো করে আসা কন্যাসন্তানের নাম রেখেছিলেন রুনা। নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থানার চানপাড়া গ্রামে সমবয়সী আর দশটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা করেই বড় হচ্ছিল সে। হঠাৎ একদিন সব থেমে যায়। ১০ বছর বয়সে মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে তার। কারণ অজানা।
মেয়ের চিকিৎসা করানোর মতো স্বচ্ছলতা রেজিয়া বেগমের দিনমজুর স্বামীর ছিল না। কম খরচের কবিরাজি চিকিৎসাই ছিল একমাত্র ভরসা। তাতে সুস্থ করা যায়নি রুনাকে। বরং গত ১৫ বছর ধরে তার মানসিক রোগ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, এখন তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা লাগে।
মায়ের ভয়, শেকল না লাগানো হলে নাড়িছেঁড়া ধন একদিন হারিয়ে যাবে।
মেয়ে সম্পর্কে রেজিয়া বেগম বলেন, “জন্মের পর ভালোই আছিল সে। হাঁটাচলা-কথাবার্তা কোনোটাতেই সমস্যা আছিল না। অন্য পোলাপানের লগে খেলত, ঘুরত।
“কিন্তু ১০ বছর বয়স থাইক্যা মাথাত সমস্যা শুরু হইল। এরপর কয়েকবার ঘর থাইক্যা বাইর হয়া গ্যাছে। তাই এখন সবসময় লগে লগে রাখি। এরপরও ঘরের বাইরে নিয়া গেলেই দৌড় দিতে চায়। তাই বাহির হওয়ার সময় হাতে শিকল লাগাই, যাতে হারায়া না যায়।”
যে মেয়ের মুখ দেখে একদিন মা হওয়ার আনন্দে ভেসেছিলেন, সেই মেয়ের হাতে শেকল পরান রেজিয়া নিজেই। শেকল পরিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করেন। কারণ তার স্বামী আব্দুল মান্নানের কর্মক্ষমতা নেই। বয়স হয়েছে।
রুনার পরে রেজিয়ার আরও চারটি ছেলেমেয়ে হয়। মেজ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে দুজন বিয়ে করে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে থাকে।
স্বামী আর দুই মেয়ের একমাত্র আশ্রয় এখন রেজিয়া। তিনি ছাড়া তাদের দেখার কেউ নেই। তাই বাধ্য হয়ে স্বামী আর ছোট মেয়েকে নেত্রকোণার চানপাড়া গ্রামে রেখে বড় মেয়ে রুনাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন রেজিয়া। উঠেছেন মিরপুরের দিয়াবাড়ির বটতলা বালুরমাঠ এলাকার এক বস্তিতে।
রবিবার দুপুরে মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় হাতে শেকল লাগানো মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন রেজিয়া। তখনই সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় তার।
রেজিয়া বলেন, “স্বামীর বয়স হইছে। এখন আর কাজ করতে পারে না। ছেলে দুটার অবস্থাও ভালো না। তারা নিজেরাই ঠিকমতো চলতে পারে না। তাই উপায় না দেখে ঢাকায় আইসা ভিক্ষা করতেছি। আমি ছাড়া মেয়েটারে কেউ সামলাইতে পারে না। তাই ওরেও নিয়ে আসছি।”
জানালেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে উপার্জন করতে পেরেছেন ৫১২ টাকা।
মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষায় বের হলে মোটামুটি এই পরিমাণ অর্থসহায়তাই পান জানিয়ে রেজিয়া বলেন, “প্রতিদিন সকালে উইঠ্যা মাইয়ারে নিয়া বাসে কইরা যেকোনো দিক চইল্যা যাই।
“এরপর হাঁইটা হাঁইটা মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলি। যা পাই, তাতে মা-মাইয়ার খাওয়া-দাওয়া আর আড়াই হাজার টাকা ঘরভাড়া দেওনের পর যা থাকে বাড়িত পাঠাই। সেডা দিয়াই ছোট মাইয়া আর ওর বাপে চলে। বড় মাইয়াটারে যে একটা ডাক্তার দেখামু, সেই উপায়ও নাই।”