নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সব আশা নিয়ে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই) প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার মধ্যে একটি আশা নিশ্চয়ই ছিল এই যে, এই ইনস্টিটিউটে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হবে। প্রায় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রধানমন্ত্রীর এই আশা, সত্যি বলতে কী, এই ইনস্টিটিউটকে নিয়ে জাতির কোনো আশাই পূরণ হয়নি।
এই হতাশার কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একটি কারণতো অবশ্যই বাংলাদেশের জ্ঞানবিমুখ, প্রায় অশিক্ষিত সমাজ। গবেষণা করার লোক এখানে নেই, গবেষণার ফলাফল লিখে প্রকাশ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন লোকও বিরল। দ্বিতীয় কারণ, আমাই-এর মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে লেখাপড়া ও গবেষণার সঙ্গে চিরসম্পর্কহীন, কোনোমতে দায় সেরে পার পেতে চাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং গবেষণাবিমুখ, মেধাহীন, তেলবাজ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক— এই দুই কিসিমের লোকই ছিলেন। এমন সব লোককে দিয়ে আর যাই হোক গবেষণা হবে না। হয়ওনি। সরকারি নিয়ম মেনে সুউচ্চ দালান তুলে আকাশ চুলকানো— এই একটা কাজই এরা করতে জানেন এবং তাই তাঁরা করে গেছেন আড়াই দশক ধরে।
নব্বই দশকের শেষদিকে যখন এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল (ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ২০০১ সালের ১৫ মার্চ) তখনই আমি লিখিত প্রস্তাব করেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ভবনে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হোক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক বিখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আপত্তি করেছিলেন এই বলে, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সব সময় গণ্ডগোল লেগে থাকে, সেহেতু এখানে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে বিদেশি গবেষকেরা এখানে আসতে চাইবেন না। ব্যস, ইনস্টিটিউট চলে গেল সেগুন বাগিচায় এবং ধীরে ধীরে পরিণত হলো (অধ্যাপক সৌরভ শিকদারের ভাষায়) ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পালিত কন্যায়’। এমন একটি মার্কামারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা আদৌ সম্ভব কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। অবশ্য স্বায়ত্তশাসিত বাংলা একাডেমি কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বা কী এমন গবেষণা হচ্ছে, সে প্রশ্নও অবান্তর নয়।
ব্যতিক্রম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সদ্যসাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক হাকিম আরিফ। দায়িত্ব নিয়েই ভাষা গবেষণা করা এবং করানোর উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছেন। বেশ কয়েকটি গবেষণা পুস্তক এবং ভাষাবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে গত দুই বছরে। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বহুভাষী অভিধান। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি ভাষা যাদুঘর, যার প্রশংসা করেছেন খোদ প্রধানন্ত্রী।
নিয়মিত সেমিনার হয়েছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে, আয়োজিত হয়েছে ভাষামেলা। নিয়মিত প্রকাশনা আর অনুষ্ঠানতো ছিলই। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন অনেকখানিই বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছিল। এর মানে হচ্ছে, ব্যক্তি যদি স্বাপ্নিক, উদ্যোগী, কর্মঠ ও মেধাবী হন, তবে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্বভাব বদলাতে না পারলেও প্রতিষ্ঠানকে কমবেশি কার্যকর করে তুলতে পারেন।
অধ্যাপক হাকিম আরিফের সবচেয়ে বড় অবদান, মাত্র কয়েক মাসে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ‘মাতৃভাষাপিডিয়া’ নামে পাঁচ খণ্ডের একটি ‘ভাষা বিশ্বকোষ’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে ‘সহ বীর্য্যম কর্বাবহৈ’, অর্থাৎ সবাই মিলে বীর্যবান অর্থাৎ বড় বড় কাজ করবো, অধ্যাপক আরিফও বাংলাদেশের সব ভাষাচিন্তকদের সাথে নিয়ে বড় একটি কাজ করতে চেয়েছেন।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের একাধিক জেলাশহরে মাতৃভাষাপিডিয়ার সম্ভাব্য ভুক্তি-লেখকদের একত্রিত করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। প্রতিটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়ে উঠেছিল ভাষাচিন্তকদের মিলনমেলা। এমন একটি উদ্যোগ বাংলাদেশের বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এই সব পরিচিতিমূলক সভা ও প্রশিক্ষণের উদ্বোধনে শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে লেখকেরা ভুক্তি লিখে পাঠাতে শুরু করেন এবং গত ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে মাতৃভাষাপিডিয়ার প্রাথমিক একটি সংস্করণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়। যে দেশে প্রায় কোনো প্রকল্পই সমাপ্ত হয় না, সেখানে এত দ্রুত এত বড় একটি কাজ সমাপ্ত করা অধ্যাপক হাকিম আরিফের মতো কর্মবীরের পক্ষেই সম্ভব। জার্মান ভাষায় যাকে বলে ‘ব্লিৎস ক্রিগ’ বা দ্রুততম সময়ে সমাপ্ত যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে অধ্যাপক হাকিম আরিফের কর্মকাণ্ডকে। স্মর্তব্য যে অধ্যাপক হাকিম আরিফ পিএইচডি করেছেন জার্মানিতে।
সম্প্রতি বাংলা ও ইংরেজিতে পাঁচখণ্ডের মাতৃভাষাপিডিয়ার বাকি খণ্ডগুলোও প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি খণ্ডে শ তিনেক পৃষ্ঠা এবং শ পাঁচেক ভুক্তি সম্বলিত হওয়া সত্ত্বেও মাতৃভাষাপিডিয়াকে সম্পূর্ণ বা ত্রুটিহীন বলে দাবি করেননি অধ্যাপক হাকিম আরিফ। সম্পাদকীয়তে তিনি বলেছেন: ‘‘পিডিয়া বা কোষরচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ সঙ্কলনগুলোতে এই মাতৃভাষাপিডিয়াকে সম্পূর্ণতর করে তোলার চেষ্টা করা হবে।’’
গত ৯ই এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে দায়িত্ব শেষ হবার পরও অধ্যাপক হাকিম আরিফ মাতৃভাষাপিডিয়ার সম্পাদনা-সংশোধন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন অনেকটাই একা, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পাঠাগারে। দুঃখজনক ব্যাপার ছিল এই যে হাতে গোনা কয়েকজন সম্পাদক ও সহকারী ছাড়া আর কাউকে তাঁর পাশে দেখা যায়নি। তাড়াহুড়ায় ‘ছা-পাখানা’ হয়, ‘প্রকাশনা’ হয় না। এদিকে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মুদ্রণ শেষ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। সুখের বিষয় এই যে মাতৃভাষাপিডিয়া অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক হাকিম আরিফ মাতৃভাষাপিডিয়া রচনার এই উদ্যোগ গ্রহণ করার আগে কারও ধারণাই ছিল না যে বাংলাদেশে ভাষাবিষয়ক ভুক্তি লেখার মতো শ দুয়েক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। এদের সবার যোগ্যতা, শিক্ষা ও লেখার মান সমান নয়, বলা বাহুল্য, কিন্তু তাঁরা যে অন্ততপক্ষে আছেন, সেটা জেনেই আমরা আহ্লাদিত। এই পিডিয়া প্রকাশিত হয়ে আরও একটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে: একজন উদ্যোগী (মহা)পরিচালক থাকলে গবেষণা-প্রকাশনা বাংলাদেশেও সম্ভব।
উল্লেখ্য যে ইতিপূর্বেও মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু সেই গবেষণার ফলাফল অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি। সব গবেষক-সম্পাদক নিজ নিজ পাওনা বুঝে নিয়ে সেই কবে থেকে পগাড় পার, কিন্তু প্রকাশনার কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেন না। গবেষণা-প্রকল্পের জন্য কেনা যাবতীয় কমপিউটার-যন্ত্রপাতি-ডকুমেন্টও নাকি কে বা কাহারা হাওয়া করে দিয়েছে। কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ঢাল! সরকারি টাকার পুরোটাই আক্ষরিক অর্থে ‘জলে’ গেছে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে মে, মাত্র চার মাসে প্রায় ১,৬০০ পৃষ্ঠার একটি মাতৃভাষা বিশ্বকোষ রচনা ও মুদ্রণ নিঃসন্দেহে একটি রেকর্ড, বাংলাদেশের মতো একটি পণ্ডিত-বর্জিত দেশের জন্যে তো বটেই, নিখিল বিশ্বের নিরিখেও। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভবিষ্যৎ কোনো পরিচালকের পক্ষে, তিনি আমলা হোন, কিংবা অধ্যাপক, অধ্যাপক হাকিম আরিফের এই রেকর্ড ভাঙা কঠিন না হলেও দুরূহ হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গত তিন দশকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অধ্যাপক হাকিম আরিফ যে ভাষাগবেষণা কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন, সেই যজ্ঞ চলমান রাখার সক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় একজন (মহা)পরিচালক হয়তো অচিরেই নির্বাচিত হবেন। সমস্যা হচ্ছে, কোনো অজ্ঞাত কারণে এ ধরনের কর্মবীর পরিচালক ক্ষমতাবানদের মনপসন্দ নয়। সুতরাং সপ্রশংস কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে অনিয়ম ও দুনীর্তির ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে নতুন পরিচালকের জীবনও দুর্বিসহ করে তুলবে কোনো কোনো মহল।
মেধাবী, কর্মঠ ও সৎ লোকের তুলনায় সেই সব মেধাহীন, অকর্মণ্য ও অসৎ লোকদেরই জয়জয়কার বাংলাদেশে, যারা কিনা বঙ্গবন্ধু কিংবা তাঁর কন্যার স্বপ্ন ও ইচ্ছাকে থোরাই কেয়ার করেন। এরাই নিজের হীন স্বার্থে যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে। ‘নেত্রী’র সামনে এদের মুখে চেতনার ভেজাল মধু, অন্তরে হলাহল, বিষ! এছাড়া গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে নীতিবিবর্জিত হলুদ সাংবাদিকতা। কী বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে, কী হাল আমলে, এটাই সোনার বাংলার করুণ বাস্তবতা।
লেখক: ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষক ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক।
ইমেইল: bhattacharjashishir@gmail.com