সড়কে মোটরবাইকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে সড়কে যে কয়টি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়েছে, তার ২৬ শতাংশই মোটরসাইকেল।
এই সময়ে ২ হাজার ২৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছে, তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ১৫২ জন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩৩৯ জন।
বছরে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এই পরিসংখ্যান এসেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি থেকে। রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
যেভাবে বাড়ছে বাইক দুর্ঘটনা
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৯ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়েছে। পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও ত্রি-হুইলার সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন, এমন গবেষকরাও বলছেন, অন্য যানের চেয়ে মোটারসাইকেলের দুর্ঘটনার ঝুঁকি ২৯ গুণ বেশি। এর প্রধান কারণ বেপরোয়া গতি। এছাড়া দুর্বল অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থা, আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক, অন্য যানকে পিছে ফেলার চেষ্টা, হুটহাট লেন বদল, চলন্ত অবস্থায় ফোনে আলাপ, যথাযথ হেলমেট ব্যবহার না করা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে সড়কে যত হতাহতের ঘটনা ঘটছে, তার ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৯৪৫ জন। এর পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৬৩ জন। ২০২১ সালে প্রাণ হারান ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯১ জন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বাইক চালকদের ৫৮ শতাংশেরই বয়স ১৪-১৮ বছরের মধ্যে। শখ পূরণে অনেক অভিভাবকই কম বয়সী সন্তানদের হাতে আধুনিক মডেলের উচ্চগতির মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছেন। এই কিশোরদের অধিকাংশই কোনো নিয়ম মানে না।
“বেপরোয়াভাবে উচ্চগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তারা। এতে একদিকে তারা নিজেরা যেমন হতাহত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ পথচারীরাও। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা মোটরসাইকেল চালকরাও বেপরোয়া। তারাও ট্রাফিক আইন মানতে চায় না, হেলমেট ছাড়াই বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালান। এই বেপরোয়া গতির কারণেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।”
সাইদুর জানান, দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের প্রায় ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেল চলে গেছে দুই ধরনের লোকের কাছে। যাদের কেউ শখ করে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, কেউ বাধ্য হয়ে। আর এদের অনেকেই হচ্ছেন অদক্ষ চালক।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআইর সাবেক পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আবদার পূরণে কিশোর-তরুণদের হাতে মোটরসাইকেল তুল দিচ্ছেন অভিভাবকরা। তরুণদের অনেকে দক্ষতা অর্জন না করে এবং নিয়ম না জেনেই মোটরসাইকেল নিয়ে মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে। মহাসড়কে গিয়ে আবার সেটিকে তারা রেসিং ট্র্যাক বানিয়ে ফেলছে। সেসব রেসিংয়ের ভিডিও ধারণ করে সেগুলো আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হচ্ছে। এসব ভিডিও দেখে প্রভাবিত হচ্ছেন আরও অনেকে। এতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। তাই অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নজরদারি আরও বাড়াতে হবে, যেন এসব ভিডিও না ছড়ায়।
সাইদুর রহমান বলেন, একটি মানসম্মত হেলমেট বাইক চালকের মৃত্যুঝুঁকি ৪৮ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু বাইক চালকদের অধিকাংশের হেলমেট নিরাপদ না। তারা হেলমেটের নামে যা মাথায় দেয়, তাকে বড় জোর ‘প্লাস্টিকের ক্যাপ’ বলা যায়।
“এসব হেলমেট প্রাণ বাঁচাতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না। শুধু ট্রাফিকের চোখ ফাঁকি দিতে এসব হেলমেট ব্যবহার করেন বাইকাররা। নিম্নমানের এসব হেলমেট মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়াচ্ছে।”
বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামোও মোটরসাইকেলবান্ধব নয় বলে মনে করেন সাইদুর।
তিনি বলেন, “সড়ক অবকাঠামো ঠিক না করেই দেশে ৩৫০ সিসির মোটরসাইকেলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়, এতে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ হবে। কারণ বেশি সিসির মোটরসাইকেল মানেই আরও বেশি গতি, বেশি ওজন। এসব মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে যেমন শারীরিক সক্ষমতা দরকার, চালকের দক্ষতা দরকার, তেমনটা আমাদের দেশের চালকদের নেই। তাই দুর্ঘটনা আরও বাড়তে পারে।”