গত ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার দিন পর্যন্ত ২১ দিনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সারা দেশে অন্তত ৬৩১ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ। নিহত ৬৩১ জনের মধ্যে অন্তত ৪৫০ জনকে মৃত অবস্থায়ই হাসপাতালে আনা হয়, বাকি ১৮১ জন মারা যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত একটি কমিটির অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ আন্দোলনে হতাহতদের প্রাথমিক এ তালিকা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ তালিকা। এমআইএস বিভাগ তালিকা সংক্রান্ত প্রতিবদেনটির কাজ শেষ করে গত ৫ সেপ্টেম্বর। এরপর প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
হতাহতদের এ তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করা হবে বলে সোমবার জানিয়েছেন কমিটির প্রধান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহাম্মদু হুমায়ুন কবির।
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া আন্দোলন জোরদার হয় গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হলে। পরদিন ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে মারা গেলে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। সেদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
এরপর আন্দোলন নতুন রূপ পায়; দেশজুড়ে বাড়ে সহিংসতা। এরই এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে।
আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন; ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
আন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা জনতে গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহাম্মদু হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি কাজ শুরু করে ১৮ আগস্ট।
এই কমিটির তত্ত্বাবধানেই মূলত কাজ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগ। কমিটি গত বৃহস্পতিবার হতাহতদের প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
কমিটির প্রধান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, আহত হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত ১৬ হাজার সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিয়েছেন। বাকি ৩ হাজারের মতো মানুষ চিকিৎসা নিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে।
তিনি জানান, হতাহত সবচেয়ে বেশি মানুষ ঢাকা বিভাগের। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ঢাকা বিভাগে, ৪৭৭ জন। এই বিভাগে আহত হয়েছে ১১ হাজারের বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগে আহতের সংখ্যা দুই হাজার।
নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৪৩ জন, খুলনা বিভাগে ৩৯ জন এবং বরিশাল বিভাগে একজন।
হুমায়ুন কবির বলেন, “যে মানুষগুলো আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বা এখনও নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে তিন হাজার ৪৮ জনের অবস্থা ছিল খুবই গুরুতর। তাদেরকে অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আর এই মানুষগুলোর ভেতরে কমপক্ষে ৫৩৫ জন রয়েছেন, আঘাতের কারণে পার্মানেন্টলি ডিজঅ্যাবল হয়ে গেছেন।”
এক প্রশ্নের জবাবে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “হতাহতের এ তালিকা পূর্ণাঙ্গ না। আরও রয়েছে, সেগুলো তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি প্রাথমিক তালিকা বলতে পারেন, সংখ্যাটি নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে।”
হতাহতদের তালিকা করে প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছেন জানিয়ে কমিটির প্রধান হুমায়ুন কবির বলেন, “আমাদের কাজ শেষ, গুছিয়ে দিয়েছি। এখন সরকারের কাজ শুরু। আমাদের সোর্স ছিল হাসপাতালগুলো। এর বাইরেও তথ্য আমরা নিয়েছি। কিন্তু সেগুলো এখন ভেরিফাই করতে হবে। কারণ হাসপাতালের বিকল্প আমাদের কাছে সে মুহূর্তে ছিল না।
“পুরো দেশেও এ সময়ের মধ্যে কাজ করা সম্ভব ছিল না আমাদের ১৪ সদস্যের এ কমিটির। আবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই চলে গেছে। বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। আমি গাইড করেছি, এখন এগুলো ভালো করে দেখা দরকার।”
তিনি বলেন, “আমরা তালিকা করে দিয়েছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন সেগুলো ভেরিফাই করবে, ডেটা এন্ট্রি হয়েছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ তারা হয়তো এটা পাবলিশ করবে।”
হুমায়ুন কবির বলেন, “মৃতদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে আনা হয়নি সে সময়। জুলাই মাসের শেষে ও আগস্টের শুরুতে অনেকেই আসতে পারেননি। নিহতের সংখ্যা বাড়বে। তবে আহতদের সংখ্যা তেমন একটা বাড়বে না বলে মনে হচ্ছে।”
এ তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের জন্য কিছু নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।