“তখন শুধু বুঝতে পারছিলাম, বাঁচতে হলে এখান থেকে বের হতে হবে”- চোখের সামনে জ্বলতে থাকা আগুন আর চারদিক অন্ধকার করা ধোঁয়ার মধ্যে এটুকুই ভাবতে পেরেছিলেন ফয়সাল মন্ডল। দ্রুতই সঙ্গে থাকা হাতুড়ি দিয়ে একটি দেওয়াল আর জানালার কাচ ভাঙতে শুরু করেন তিনিসহ সহকর্মীরা।
গত ২০ জুলাই ১০ তলা ওই ভবন থেকে কোনও রকমে বের হতে পারলেও পুড়ে যায় ফয়সালের হাত, পা ও শরীরের কিছু অংশ। এরপর নিচে নেমে কিছু দূর হেঁটে সড়কের ওপর পড়ে যান। সেখানেই একজন নারী ফয়সাল আর তার সহকর্মী মাহবুবকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তুলে দেন অটোরিকশায়।
ওই রাতেই ঢাকার সাভারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন ফয়সাল ও মাহবুব। পরদিন ২১ জুলাই অ্যাম্বুলেন্সে করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তারা। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন রয়েছেন নিজ নিজ বাড়িতে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর গত ২০ জুলাই ঢাকার যাত্রবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের কাচপুর পর্যন্ত এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। চিটাগং রোড এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।
সংঘর্ষ চলার মধ্যে সেখানেই গত ২০ জুলাই একটি ১০ তলা ভবনে আগুন দেওয়া হয়। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বেসরকারি ব্যাংকের একটি শাখায় সাজসজ্জার কাজ করছিলেন ফয়সাল (১৮)সহ ১৪ জন।
ওই আগুনে পুড়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর দুজনসহ প্রাণ হারায় মোট তিনজন। আহত হন ফয়সাল ও মাহবুব বিশ্বাসসহ কয়েকজন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে ফয়সাল।
রবিবার বিকালে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে যখন তার কথা হয়, তখনও তার বিভীষিকা কাটেনি।
“এখনও গা শিউরে উঠছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আগুন আর চারদিক অন্ধকার করা ধোঁয়া। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছিল না।”
ফয়সাল বলেন, “আমরা ১৪ জন ব্যাংকে কাজ করছিলাম। দুপুরের দিকে ভবনের বাইরে থেকে শুধু গুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আর বিকালের দিকে গেটে আগুন দিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।”
অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথ ধরেছিলেন ফয়সাল। আগুনের এই ঘটনা তার মনে আতঙ্কের সঙ্গে হতাশাও তৈরি করেছে।
ফয়সালের সহকর্মী মাহবুব চর ভবানীপুর গ্রামেরই কৃষক আক্কাছ বিশ্বাসের ছেলে। ভগ্নিপতির সঙ্গে কাজে গিয়েছিলেন তিনি। আগুনে পুড়ে যায় তার হাত, পা।
টিনশেডের মাটির ঘরে শুয়ে মাহবুব বলেন, “এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারছি না। চোখ বুজলেই সেদিনের দৃশ্য ভেসে উঠছে। এখনও কানে বাজছে গুলির শব্দ।
“বিশ্বাসই হয় না যে এখনও বেঁচে আছি।”
নারায়ণগঞ্জের ওই ১০ তলা ভবনে একটি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। আর নিচতলায় ছিল মার্কেট।
ফয়সাল ও মাহবুব জানান, বিক্ষোভকারীরা ভাংচুর ও আগুন দেওয়ার পাশাপাশি তাদের দুজনের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে মারধর করেছিল। পরে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে তারা রক্ষা পান।
বিকাল ৪টার দিকে ভবনের বাইরে থেকে বিক্ষোভকারীরা ইট ছুড়তে শুরু করে। শোনা যায় গুলির শব্দও। সাড়ে ৪টার দিকে ব্যাংকের প্রবেশপথে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
চর ভবানীপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে সেদিনের আগুনে প্রাণ হারান মাহবুবের বোনের ছেলে সেলিম মণ্ডল (২৮), ফুফাত বোনের স্বামী আব্দুস সালাম (২৪)। আহতদের মধ্যে আব্দুল হামিদ ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মাহবুবের বাবা আক্কাছ বিশ্বাস বলেন, “আগুনে পুড়ে আমার দুই জামাই মারা গেছেন। ছেলে ও আত্মীয় আহত হয়েছে। ওরা তো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ আন্দোলনে ছিল না। আমি এর সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই।”