ভালোবাসার সুবাস মেশানো বসন্ত বাতাস বইছে চারিদিকে। এই সময় প্রিয়জনের সঙ্গে ঘোরাফেরা, উপহার বিনিময়, খাওয়াদাওয়া তো হতেই হবে। যারা একটু একান্তে সময় কাটাতে চান, তারা ভীষণ রোমান্টিক সিনেমা দেখে হাসি ও ভালোবাসায় সময়টা কাটাতে পারেন। স্বামী আর স্ত্রী বাড়িতে বড় স্ক্রিনে সিনেমা ছেড়ে দেখার সময় চাইলে পপকর্ন নিয়েও বসতে পারেন।
হলে গিয়ে পুরনো সিনেমাগুলো হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই ভরসা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম অথবা ইন্টারনেট ডাউনলোড।
কোন সিনেমা দেখবেন, সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একেবারে সহজ নয় অবশ্য। ভাবতে ভাবতে ভালোবাসার দিনটা যেন ফুরিয়ে না যায়, তাই পাঁচটি দারুণ রোমান্টিক সিনেমা মনে করিয়ে দিচ্ছে সকাল সন্ধ্যা।
যারা আগে দেখেছেন অথবা যারা এখনও দেখেননি, তারা অবশ্যই এই ভালোবাসার সিনেমাগুলো দেখা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবেন না।
৭০ বসন্ত আগের রোমান হলিডে
পথেঘাটে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়া তরুণীকে বাড়ি বয়ে নিয়ে আসেন সাংবাদিক জো ব্র্যাডলি। এরপর ঘটনাক্রমে জো জেনে যায় এই তরুণী আসলে প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে আসা রাজকুমারী অ্যান। জো তার পত্রিকার সম্পাদকের কাছে চমক দেখাতে দাবি করে বসে রাজকুমারীর বিশেষ সাক্ষাৎকার এনে দেবে সে। জো তার আলোকচিত্রী বন্ধুকে নিয়ে নেমে পড়ে নতুন মিশনে।
রাজকীয় রেওয়াজ একঘেয়ে হয়ে উঠলে প্রাসাদ ছেড়ে পালান রাজকুমারী অ্যান। তার জন্য রোম ঘুরে দেখার সুযোগ নিয়ে আসে সাধারণ মানুষ জো ব্র্যাডলি। তারা রোমে ভেপসা চালিয়ে যানজটের মধ্যে পুলিশের হাতে আটক হয়। আবার ছাড়াও পায়। তারা এক সঙ্গে নাচে। প্রাসাদের লোকেদের নজরে পড়লে তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তারপর দুজনের প্রথম চুম্বন।
যদিও এই প্রেমে বিচ্ছেদ নামে অচিরেই। রাজকুমারী অ্যান ফিরে আসেন প্রাসাদে। স্থগিত করা সেই সংবাদ সম্মেলন আবার হয়। তাতে জো ব্র্যাডলি এবং তার আলোকচিত্রী বন্ধুও হাজির হয়। রাজকুমারী নিজের আবেগ সংবরণ করে ঘোষণা দেন, জনগণের প্রতি ভালোবাসাই তার প্রধান কর্তব্য।
ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন এই সিনেমায় রাজকুমারী অ্যান চরিত্রে জয় করেন সেরা অভিনেত্রীর একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস। ২৩ বছর বয়সে এই সিনেমা দিয়ে হলিউডে অভিষেক হয়েছিল তার। এদিকে তাকানোর ভঙ্গি দিয়েই দর্শকের মন জিতে নিয়েছিলেন ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার গ্রেগরি পেক।
১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় এই রোমান্টিক কমেডি ঘরানার সিনেমা। আমেরিকার বাইরে কোথাও প্রথম শুটিং হয়েছিল রোমান হলিডে দিয়েই। রোমান হলিডে সিনেমার দৃশ্যায়ন অবশ্যই ইতালিতেই হয়েছিল।
উইলিয়াম ওয়াইলার নাকি ইচ্ছে করেই এই সিনেমা পর্দায় সাদাকালো রেখেছেন; যেন সবার নিবিড় মনোযোগ থাকে চরিত্রগুলোকে ঘিরে। হয়েছেও তাই। ৭০ বছর আগের এই সাদাকালো ছায়াছবিকে এখনও আধুনিক রোমান্টিক সিনেমা বলা যায় অনায়াসে। তাই রোমান হলিডে বারবার দেখার তালিকায় রাখতে পারে যে কোনো প্রজন্ম।
আইএমডিবিতে এই সিনেমার রেটিং ৮.০/১০। আর রটেন টমেটোর টমেটো মিটারে রোমান হলিডের রেটিং ৮.৫/১০।
জুলিয়া রবার্টস যখন প্রিটি ওমেন
জুলিয়া রবার্টস আর প্রিটি ওমেন সমার্থক হয়ে আছে ভক্তদের কাছে। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া প্রিটি ওমেন সিনেমায় রিচার্ড গিয়ার আর জুলিয়া রবার্টসের রসায়ন মন খুলে ভালোবাসার কথা খুব আলতো করে বলে।
ধনাঢ্য এডওয়ার্ড লুইস হলিউড বুলভার্ডে গিয়ে হারিয়ে যান। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হলো ভিভিয়ান ওয়ার্ডের; যে একজন যৌনকর্মী। তারই সাহায্য নিয়ে হোটেলে ফিরল এডওয়ার্ড। হোটেলে সেই রাত যাপনে ভিভিয়ানকে ভাড়া করে এডওয়ার্ড। যদিও রাত পার হলেও ভিভিয়ানের সঙ্গ ছাড়ছিল না এডওয়ার্ড। বরং ভিভিয়ানকে নতুন জামা কেনার অর্থ দেয়।
ভিভিয়ানের নতুন সাজে তার প্রতি আরও অনুরক্ত হয়ে ওঠে এডওয়ার্ড। ভিভিয়ানও প্রেমে পড়ে এডওয়ার্ডের। কিন্তু এক পর্যায়ে মনে হয় এডওয়ার্ড তাকে প্রেমিকা নয়, বরং যৌনকর্মীর মতো দেখছে বলে মনে হয় ভিভিয়ানের। এডওয়ার্ড যখন আবার এক সঙ্গে রাত যাপনের প্রস্তাব রাখে তা প্রত্যাখ্যান করে চলে যায় ভিভিয়ান। এভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এডওয়ার্ডের অনুভূতি যেন দিশা ফিরে পায়। রূপকথার গল্পের নায়কের মতো এডওয়ার্ড আবার ভিভিয়ানের জীবনে ফিরে আসে।
যারা সালমান খান, প্রীতি জিনতা আর রানি মুখার্জির হিন্দি সিনেমা চোরি চোরি চুপকে চুপকে দেখেছেন, তারা শুরুর দিকে কিছু দৃশ্য ধরে নিতে পারেন প্রিটি ওমেন সিনেমা থেকেই অনুকরণ করা।
মুক্তির পর গ্যারি মার্শাল পরিচালিত প্রিটি ওমেন ইউএস বক্স অফিসের শীর্ষ জায়গা দখল করেছিল।
আইএমডিবি এই সিনেমার রেটিং দিয়েছে ৭.১/১০। রটেন টমেটো দিয়েছে ৬.০/১০।
রূপকথার নটিং হিল
রূপকথা ছাড়া নাম আর যশে তুঙ্গে থাকা একজন নায়িকা কি পর্দার বাইরে সাধারণ কাউকে ভালোবাসতে পারে?
লন্ডনের নটিং হিল শহরে একটা বইয়ের দোকান চালায় উইলিয়াম থ্যাকার। একদিন সেই দোকানে এসে বই কেনে তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা অ্যানা স্কট। পরিচয়ের গোড়াতেই অ্যানা নিজের অজান্তেই দুর্বল হয়ে যায় উইলিয়ামের প্রতি।
এরপর তাদের আবার দেখা হয় এবং ভালোলাগার পর্ব এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর ভুল বোঝাবুঝির পর্বও আসে তাদের মাঝে। অ্যানা তার ভালোবাসা প্রকাশে অকপট হলেও উইলিয়াম পিছিয়ে যায়। তার ভয়, অ্যানা তাকে ছেড়ে যাবে। যদিও পরে উইলিয়াম নিজের ভুল পারে। তারপর বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে ছুটে আসে অ্যানা স্টকের সংবাদ সম্মেলনে। অ্যানা ততক্ষণে সিনেমা থেকে সরে লন্ডনে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
অ্যানাকে ফিরে পেতে সাংবাদিকদের মাঝে থাকা উইলিয়াম প্রশ্ন করে, ক্ষমা চাইলে কি বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার সুযোগ পাবে তারা? উইলিয়ামের ভালোবাসায় নিজের ভালোবাসা মেলায় অ্যানা। তারা বিয়ে করে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে বিমোহিত হবেন দর্শক; পার্কে বেঞ্চে বসে বই পড়ছে উইলিয়াম, আর অন্তঃসত্ত্বা অ্যানা তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
রোমান হলিডে সিনেমার মতো রূপকথার আমেজ এনে দেয় জুলিয়া রবার্টস ও হিউ গ্রান্ট অভিনীত নটিং হিল। রাজকন্যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রেম হলেও মধুর পরিণয় দেখায়নি রোমান হলিডে। সেই কমতি মিটিয়ে দিয়েছে নটিং হিল। নায়িকা আর এক বইয়ের দোকানির প্রেম গড়ায় পরিণয়ে; যাকে বলে হ্যাপি এন্ডিং।
জুলিয়া বরার্টসের হাসি আর হিউ গ্রান্টের ব্রিটিশ ভঙ্গিমায় আধো আধো কথা অদ্ভুত রসায়ন ছড়িয়ে দেয় এই সিনেমায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই রসায়নই স্ক্রিনে ধরে রাখবে আজকের দর্শককেও। মনে হবে, ভালোবাসার গল্প এমন দারুণ করেই বলতে হয়।
রজার মিশেল পরিচালিত নটিং হিল মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। বক্স অফিস উপচানো আয় করেছিল এই সিনেমা; ঝুলিতে পুরে নিয়েছিল অনেক পুরস্কারও।
আইএমডিবিতে এই সিনেমা রেটিং পেয়েছে ৭.২/১০; আর রটেন টমেটোতে রেটিং ৭.১/১০।
ভালোবাসার ফিরে আসার সেরেনডিপিটি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে ধার করে অনেকেই বলেন, যাকে ভালোবাসেন তাকে মুক্তি দিন। যদি সে ফিরে আসে তবে ওই ভালোবাসা আপনারই। আর যদি না আসে, তবে সে ভালোবাসা আপনার ছিলই না কোনোদিন।
মনে মনে খুব করে কিছু চাইছেন। আর তাই আপনাকে চমকে দিয়ে আপনার সামনে হাজির হলো। আপনি কিছু একটা খুঁজছেন; পাওয়ার কোনো রকম সম্ভাবনা না থাকার পরও আপনি কোথাও গিয়ে তা পেয়ে গেলেন। জীবনের এই জাদুবাস্তব ঘটনা হচ্ছে সেরেনডিপিটি।
এক দোকানে একই জোড়া মোজায় হাত পড়ে সারা ও জোনাথনের। প্রথম দেখাতে দুজনেরই ভালো লাগে দুজনকে। কিন্তু সারা জানায়, সে পরখ করে দেখবে এই দৈবযোগ কি সত্যিই তাদের এক করতে চায়?
আর এই পরীক্ষা করতে গিয়ে দুজন হারিয়ে যায় দুজনের জীবন থেকে। তারপর নিজ নিজ জীবনে প্রেম-বিয়ে নিয়ে অদ্ভুত জটিলতায় ভর করে আবার হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে একে অন্যকে।
অনেক বছর পর এক এক করে দুজনের জীবনে ফিরে আসে লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা বইটি, ফোন নম্বর লেখা সেই চিরকুট আর সেই এক জোড়া মোজা। দুজনের আবার দেখা হয়। দুজন অনুভব করে, তারা শুধু একে অন্যের জন্যই।
পিটার চেলসম পরিচালিত এই রোমান্টিক কমেডি সিনেমা মুক্তি পায় ২০০১ সালে। সিনেমায় সারা চরিত্রে ছিলেন কেট বেকিনসেল এবং জোনাথন হয়েছিলেন জন কুসাক।
এই সিনেমা দুর্দান্ত তালিকায় রাখার মতো নয়; বরং গড়পড়তা। তবু সিনেমা দেখে মিষ্টি আমেজ ও মজা দুটোই মনে থাকবে।
আইএমডিবিতে সেরেনডিপিটি সিনেমার রেটিং ৬.৮/১০। টমেটো মিটারে এই সিনেমার রেটিং ৫.৮/১০।
ভুলতে ভুলতে ভালোবাসার ফিফটি ফার্স্ট ডেটস
মন দেওয়া-নেওয়ায় প্রতিশ্রুতি দিতে বড্ড ভয় পেতো হেনরি। সেই হেনরি লুসিকে প্রথম দেখার পর মনে মনে তাকেই ভাবতে ভাবতে থাকে। পরদিন লুসির সঙ্গে সকালের নাশতা করার সুযোগও চলে আসে। তারা এরপরের সকালে আবারও এক সঙ্গে নাশতা করবে বলে ঠিক করে। কিন্তু পরদিন লুসি আর চিনতে পারে না হেনরিকে। এতে অবাক হেনরি জানতে পারে এক দুর্ঘটনায় লুসির স্মৃতিশক্তি তছনছ হয়ে গেছে। প্রতিদিন যা কিছু হয়, রাতে ঘুমের মধ্যে সব ভুলে যায় লুসি।
হেনরি এরপর থেকে প্রতিদিন লুসির সঙ্গে সকালের নাশতা খাবার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সবদিন সমান যায় না হেনরি আর লুসির; কোনোদিন প্রেম হয়, কোনোদিন হয় না। ঘটনা এগিয়ে চলতে থাকে। দুজনের ঘনিষ্টতা তালমিল রেখে চলে। তারপর বিরহ ও বিচ্ছেদ বাগড়া দেয়।
হেনরির হঠাৎ মনে হয় লুসি কিছু কিছু নতুন স্মৃতিও মনে রাখতে পারে। তাহলে লুসির স্মৃতিশক্তি হয়তো নতুন ভাবে ঠিক হবে এই আশার আলো দেখা দেয়। হেনরি দেখা করতে এলে লুসি তাকে চিনতে পারে না। অথচ হেনরিকে সে স্বপ্নে দেখেছে বলে জানায়। আর স্বপ্নে দেখা হেনরিকে সে এঁকেছেও।
হেনরি আর লুসির সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। রোজ সকালে চোখ খুলে টেপ রেকর্ডারে পুরনো বৃত্তান্ত শুনতে পায় লুসি। তারপর বাইরে বেরিয়ে হেনরি ও তাদের সন্তানের দেখা পায়।
সিনেমায় শর্ট টার্ম মেমরি লস দেখানো হলেও ২০০৪ সাল মানে ২০ বছর আগের এই সিনেমায় ড্রিউ ব্যারিমোর আর অ্যাডাম স্যান্ডলারকে এখনও দর্শকরা মনে রেখেছেন। পিটার সেগাল পরিচালিত সিনেমাটি সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভ্যালেন্টাইন ডের আগের সপ্তাহেই মুক্তি পেয়েছিল। এই সিনেমার আইএমডিবি রেটিং হচ্ছে ৬.৮/১০। টমেটো মিটারে এই সিনেমার রেটিং উঠেছে ৫.৪০/১০।