বাংলাদেশে মোট আমদানি পণ্যের ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে, যার পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই আমদানির প্রায় পুরোটাই আসে সমুদ্রপথে জাহাজে। তার বেশিরভাগই সরবরাহ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
বিপুল এই আমদানি পণ্য পরিবহনের ভাগ বসাতে আগে থেকেই বিশ্বের শীর্ষ শিপিং লাইনগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। কেউ সাশ্রয়ী ভাড়ায়, কেউ নতুন রুট চালু, আবার কেউ সরাসরি জাহাজসেবা চালুর মতো নতুন কৌশল নিয়ে এই বিশাল বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
সাংহাই-চট্টগ্রাম রুটে আগে থেকেই বিদেশি চারটি শিপিং লাইন সরাসরি সার্ভিস পরিচালনা করছে। এই প্রতিযোগিতায় নতুন করে যোগ দিচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং লাইন মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি)। জুলাই মাসেই এই রুটে সরাসরি কন্টেইনার জাহাজ সার্ভিস চালু করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে চীনের সাংহাই বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি পণ্যভর্তি কন্টেইনার পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ১২দিন।
এমএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি সপ্তাহে একটি জাহাজ দিয়ে এই সেবা শুরু করবে, এজন্য ছয়টি জাহাজ বরাদ্দ দিয়েছে। ইতোমধ্যে তিনটি জাহাজের অনুমতি মিলেছে চট্টগ্রাম বন্দরের।
আগামী ১৫-১৭ জুলাইয়ের মধ্যে এমএসসির জাহাজসেবা চালু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা।
এমএসসির সার্ভিস চালুর খবরে আশা বাড়ছে দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। আর আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বাড়লে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় বাড়বে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
এর কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রয়েছেন। এই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই তার প্রথম চীন সফর। এ সফরে ২০-২২টি সমঝোতা স্মারক সই হবে। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। ফলে নতুন এই জাহাজ সার্ভিসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চীন থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি হয় এবং প্রবৃদ্ধি দিন দিন বাড়ছে। ফলে এই পণ্য পরিবহনের বিশাল বাজারে নতুন প্রতিযোগী আসলে পণ্য উঠানামা বাবদ চট্টগ্রাম বন্দরের আয় বাড়বে। একটি বাড়তি কানেকটিভিটি তৈরি হবে।
“আর বড় বিষয় হচ্ছে- এই রুটে নতুন প্রতিযোগী আসলে বিকল্প তৈরি হবে, আর গ্রাহকদের বাছাই করার সুযোগ তৈরি হবে। শিপিং লাইনগুলোর এই প্রতিযোগিতার কারণে ভোক্তারাই শেষপর্যন্ত লাভবান হবেন।”
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এমএসসি এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিপিং লাইন। আর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট মারকো শিপিং লাইন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন কর্ণফুলী গ্রুপ।
সাংহাই-চট্টগ্রাম রুটে ২০২২ সালে সরাসরি সার্ভিস চালু করে মাঝপথে বন্ধ করে দেয় এমএসসি। এখন আবার কেন সার্ভিস চালু করছে জানতে চাইলে এমএসসির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে চান।
এক কর্মকর্তা বলেন, “এই রুটে প্রচুর ডিমান্ড আছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে আমরা সার্ভিস পরিচালনা করতে পারিনি। এখন বিশ্বজুড়েই আমাদের জাহাজ সংখ্যা বেড়েছে। আর বাংলাদেশে আমরা আমদানি পণ্য পরিবহন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছি। তাই চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের বাজার ধরার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সার্ভিস চালু করছি। আমাদের যে সার্ভিস-কানেকটিভিট, তাতে নিশ্চয়ই আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো করবো।”
বর্তমানে সাংহাই-চট্টগ্রাম রুটে যে চারটি বিদেশি শিপিং লাইন সরাসরি কন্টেইনার জাহাজ পরিচালনা করছে, সেগুলো গত বছর ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য পরিবহন করেছে। সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালুর পর চীন থেকে ট্রানজিট বন্দর হয়ে খুব কম কন্টেইনারভর্তি আমদানি পণ্য এখন চট্টগ্রাম আসে। অর্থাৎ সরাসরি সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সার্ভিস।
সাংহাই-চট্টগ্রাম রুটে ২০১১ সালে প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল লাইন (পিআইএল) প্রথম জাহাজ সার্ভিস চালু করেছিল। বেশ কিছুদিন চলার পর সেই সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়। মূলত সার্ভিসটি শুধু একমুখী- আমদানি নির্ভর, সেই কারণে সেটি স্থায়ী হয়নি। সেসব ভুল-ত্রুটি শুধরে নতুন করে যাত্রা শুরু করে চারটি শিপিং লাইন। সেগুলো হচ্ছে, ড্যানিশভিত্তিক মেয়ারস্ক লাইন, হংকংভিত্তিক এসআইটিসি, কোরিয়াভিত্তিক সিনোকর-হুন্দাই এবং ফ্রাঞ্চভিত্তিক সিএনসি লাইন।
এর মধ্যে কন্টেইনার নেভিগেশন কোম্পানি (সিএনসি) লাইন চালু করেছে বিবিএক্স-২ সার্ভিস। যেটি চীনের সাংহাই থেকে রওনা দিয়ে নিমবো, কৌশিন, সিকো বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতে সময় লাগবে ১৫ দিন। সপ্তাহে দুটি জাহাজ চলছে এই রুটে। ২০২১ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সার্ভিসটি চালু আছে।
সিএনসি লাইনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “চারটি সার্ভিসের মধ্যে আমাদের জাহাজ ব্রান্ড নিউ ও সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটির। আমাদের একেকটি জাহাজে ২৯৫৪ একক কন্টেইনার পরিবহন সক্ষমতার।
“ফলে এক সাথে বেশি কন্টেইনার পরিবহন সক্ষমতার কারণে আমরা তুলনামূলক সাশ্রয়ী ভাড়ায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দিচ্ছি। আর সেই সময়ে মেয়ারস্ক লাইনের সাথে যদি আমরা প্রতিযোগিতায় না আসতাম তাহলে এই রুটে ভাড়া অনেক বেশি থাকতো। ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য আনতে হতো।”
জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাজের সংখ্যা বিবেচনায় এই সাংহাই-চট্টগ্রাম রুটে সবচেয়ে বেশি জাহাজ পরিচালনা করছে এসআইটিসি, তাদের জাহাজের সংখ্যা ৭টি। তারা সপ্তাহে দুটি জাহাজ পরিচালনা করছে। মেয়ারস্ক লাইনের জাহাজ ৬টির মতো। প্রতিষ্ঠানটি সপ্তাহে ১-২টি জাহাজ পরিচালনা করলেও সেটি সরাসরি নয়। ফলে আসলে তারা কত পরিমাণ কন্টেইনার এই রুটে পরিবহন করে, তা জানা যায়নি। এরপর আছে সিনোকর-হুন্দাই কোম্পানি, তাদের জাহাজ পাঁচটি। তারা সপ্তাহে একটি জাহাজ চালাচ্ছে। সিএনসি লাইনের জাহাজ আছে ৫টি, তারা সপ্তাহে একটি জাহাজ পরিচালনা করছে।
এমএসসি সপ্তাহে একটি জাহাজ পরিচালনা করবে। অর্থাৎ এমএসসি যোগ হলে পাঁচটি শিপিং লাইন এই রুটে সপ্তাহে ছয় থেকে সাতটি জাহাজ পরিচালনা করবে। প্রতিটি সার্ভিসের চীনের সাংহাই বন্দর থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে ১২ থেকে ১৬ দিন সময় লাগছে। সব জাহাজ সাংহাই পৌঁছার আগে দক্ষিণ চীনের সমুদ্রবন্দর নিমবো, কৌশিন, সিকো, কিংডা থেকে পণ্য নেয়। সর্বশেষ সাংহাই থেকেই সরাসরি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কোরিয়ার মালিকানাধীন দুটি কোম্পানি যৌথভাবে ২০১৮ সাল থেকেই কোরিয়া-চীন-বাংলাদেশ (কেসিবি) নাম দিয়ে পাঁচটি জাহাজ দিয়ে সপ্তাহে একটি জাহাজ পরিচালনা করছে। সাংহাই থেকে মাত্র ১২দিনে আমদানি কন্টেইনার চট্টগ্রাম পৌঁছে দিচ্ছে সার্ভিসটি।
সিনোকর বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুল হক চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এই সার্ভিস নিয়মিত পরিচালনার কারণে গ্রাহকদের আস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের ট্রানজিট টাইম অনেক কম, ভাড়া সাশ্রয়ী পাশাপাশি ইনটাইম ডেলিভারির কারণে আমরা খুবই ভালো করছি।
“চীন থেকে পণ্য আমদানি দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের এক্সেসরিজ, কাঁচামাল চীন থেকে সরাসরি আসার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই সার্ভিসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এর ফলে দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপাদনে লিড টাইম ফিক্সড করতে পারছেন। আগে যে পণ্য ২৫ দিনে চীন থেকে আসতো, এখন সেটি আসছে ১২ দিনে। এই সময় সাশ্রয় হওয়ায় প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিরা আগাচ্ছেন।”
এসআইটিসি চীন-বাংলাদেশ এক্সপ্রেস সার্ভিস (সিবিএক্স) নামে ২০২০ সাল থেকেই সপ্তাহে দুটি জাহাজ চালাচ্ছে এই রুটে। সাংহাই থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে তাদের সময় লাগছে ১৬ দিন।
এসআইটিসির বাংলাদেশের এজেন্ট ফ্যামফা সলিউশন লিমিটেডের পরিচালক এএইচএম কামাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথমত আমাদের মূল কোম্পানিটি চীনের সেই অঞ্চলে দ্বিতীয়স্থানে আছে। সেই কানেকটিভিটি কাজে লাগিয়ে আমরা বেশি সংখ্যক জাহাজ পরিচালনা করছি। আবার ২০২১ সাল থেকে আমাদের সার্ভিসটি একেবারে বিরতিহীন ছিল, ফলে গ্রাহকদের ভালো আস্থা তৈরি হয়েছে। আর গ্রাহক সেবা হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সবমিলিয়ে ভালোভাবেই আগাচ্ছি।”
এর মধ্যে সিএনসি লাইন চালু করেছে বিবিএক্স-২ সার্ভিস। যেটি চীনের সাংহাই থেকে রওনা দিয়ে নিমবো, কৌশিন, সিকো বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতে সময় লাগবে ১৫ দিন। সপ্তাহে একটি জাহাজ চলছে এই রুটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে মোট ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য এসেছে চীন থেকে। শতাংশের হিসাবে এর পরিমাণ ২০ শতাংশ। চীন থেকে সবচেয়ে বেশি আসে তুলা; যেটি তৈরি পোশাক শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। এরপর ইলেকট্রনিক্স ও মেশিনারিজ পণ্য।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের নির্ভরতা চীনের ওপর সবচেয়ে বেশি। কারণ, কাঁচামাল সঠিক সময়ে আনতে পারলেই দেশে উৎপাদন ঠিক থাকবে এবং রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জনের কাজটি সহজ হয়।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গার্মেন্টের কাঁচামাল যত দ্রুত পাব, ততই পণ্য উৎপাদন সময় আমাদের কমে আসবে। পণ্য উৎপাদন থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময় ঠিক রাখার জন্য এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“কয়েক বছর ধরেই আমরা সরাসরি চীন থেকে চট্টগ্রামে কাঁচামাল আনতে পারছি। ট্রানজিট টাইম এড়িয়ে যেতে পারায় সেই সময়টা আমরা পণ্য উৎপাদনে কাজে লাগাচ্ছি। এতে ভালো সুফল মিলছে।”
তিনি বলেন, “এখন যদি নতুন সার্ভিস এই রুটে যুক্ত হয় তাহলে অবশ্যই প্রতিযোগিতা বাড়বে। আর প্রতিযোগিতা বাড়লেই আমাদের বিকল্প বাছাইযের সুযোগ তৈরি হবে। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে আমদানি পণ্য দ্রুত আনার পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের বাজার ধরতে সুফল মিলবে।”