Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

আলামত ‘খুনে’ পার পাচ্ছে খুনিরা

SS-crime-scene-sign-180224
[publishpress_authors_box]

সব ঘটনাই দুর্ঘটনা নয়। কিছু ঘটনা হত্যাকাণ্ড হলেও অনেক সময় দুর্ঘটনা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত থাকে আলামত, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে। তবে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের প্রধান উপাদান আলামত সংগ্রহ নিয়েই থানা-পুলিশের অনীহার অভিযোগ আছে। আরও অভিযোগ আছে, অবস্থাসম্পন্ন বা নামিদামি ব্যক্তির ঘটনা যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, সাধারণ বা নিম্নবিত্ত মানুষের ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্ব না দেওয়ার।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ভেসে আসা, গন্ধ ছড়ানো মৃতদেহে হত্যার আলামত থাকলেও সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ করেন না সংশ্লিষ্টরা। আলামত নষ্ট হয়ে গেছে বলেও দায় সারতে দেখা যায় অনেক সময়।

তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, থানা পুলিশ যথাসময়ে ঘটনার সব আলামত সংগ্রহ করতে পারে না আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে; যেসব সরঞ্জাম আছে পিবিআইসহ পুলিশের অন্যান্য সংস্থার কাছে।

আলামত ঠিকমতো সংগ্রহ না করার এমন অভিযোগ আছে ঢাকা মহানগরের পল্টন থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে চামেলীবাগের একটি বাসার বাথরুম থেকে রোজিনা নামের ১১ বছর বয়সী এক গৃহকর্মীর মরদেহ পাওয়ার পর এ অভিযোগ করা হয়।

পল্টন থানা পুলিশ তাদের সুরতহাল প্রতিবেদনে আত্মহত্যার আলামত পাওয়ার দাবি করে। বলা হয়, বাথরুমের কাপড় রাখার হ্যাঙ্গারে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলে ছিল রোজিনার মরদেহ।

তবে রোজিনার বাবা আইয়ুব আলী এ প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার ধারণা, মেয়ে খুন হয়েছে।

আইয়ুব আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রোজিনা ঝুলে ছিল বললে ভুল হবে। ওর হাঁটু মেঝেতে লেগে ছিল। বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল তার (গুনা) দিয়ে। অথচ পল্টন থানা পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে রোজিনার আত্মহত্যার। তার দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগানোর কথাই উল্লেখ করেনি পুলিশ।”

পেশায় রাজমিস্ত্রি আইয়ুব তার মেয়েকে হত্যার অভিযোগ এনে পল্টন থানায় মামলা করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানান, কিন্তু পল্টন থানা সে মামলা নেয়নি। তিনি হত্যা মামলাটি করেন আদালতে। আদালত মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইকে।

পিবিআই প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন আদালতে দেয় তাতেও রোজিনার আত্মহত্যার কথা বলা হয়। আইয়ুব নারাজি আবেদন করলে আদালত তদন্তের নতুন দায়িত্ব দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডিকে। সেই তদন্ত এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সিআইডি।

আইয়ুব আলী মনে করেন, আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলে চার বছর ধরে মেয়ের মৃত্যুর কারণ জানার অপেক্ষায় থাকতে হতো না।

আক্ষেপ করে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমি রাজমিস্ত্রি। ওরা বড় লোক। পুলিশ আলমত সংগ্রহ নিয়ে আগ্রহী ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ কোনও আলামতই পুলিশ সংগ্রহ করেনি। যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা মনগড়া, শিখিয়ে দেওয়া। ঠিকমতো আলামত সংগ্রহ করলে রিপোর্ট আসতো হত্যার। রোজিনাকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিল কোমলের স্ত্রী।”

ঢাকার তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকায় রাবেয়া (২৬) নামের এক নারীর মৃত্যুর আলামত সংগ্রহ নিয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে অনীহার অভিযোগ আছে। কামারপাড়া তিনতলা এক বাড়ির দুই তলার এক কক্ষে ভাড়া থাকতেন রাবেয়া।

তার বাবা দিনমজুর আক্কাস আলী বলছেন, ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো ছিল মরদেহ। লাশ দেখে মনে হয়েছিল, কয়েকদিন আগেই রাবেয়ার মৃত্যু হয়। ফ্লোরে জামা-কাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। রক্তও ছিল ফ্লোরে। অথচ পুলিশ ঠিকমতো আলামত সংগ্রহ না করেই বলে দেয় রাবেয়া আত্মহত্যা করেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তুরাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আক্কাস আলী বলেন, “পুলিশ আলামত তো সংগ্রহ করেইনি। উল্টো আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে আমাকে থানায় তুলে নিয়ে যায়। সই রাখে- বাবার কাছে এক হাজার টাকা চেয়ে না পেয়ে আত্মহত্যা করেন রাবেয়া, এমন কাগজে।”

রাবেয়ার বাবার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খায়ের বলেন, “এগুলো সব মিথ্যা, বানোয়াট কথা। কারও থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি। আলামতে যা পাওয়া গেছে তাই লেখা হয়েছে।”

পিবিআই বলছে, আলামত সংগ্রহের জন্য যে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকার কথা সেগুলো থানা পুলিশের কাছে কম আছে। অন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে সেগুলো পর্যাপ্ত রয়েছে। এ জন্য অন্য সংস্থা দ্রুত তদন্ত শেষ করতে পারলেও পারে না থানা পুলিশ। থানা পুলিশ যে আলামত নষ্ট করে তাও ঢালাওভাবে বলা ঠিক হবে না। উৎসাহী জনতার কারণেও আলামত নষ্ট হয়।

থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের, আলামত সংগ্রহের অনীহার অভিযোগের প্রসঙ্গে কথা হয় পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবু ইউসুফের সঙ্গে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আলামত নষ্ট করা হয়, বিষয়টা এভাবে না বলি। থানা পুলিশের কাছে আলামত সংগ্রহের পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকাই অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। বিষয়টাকে তদন্তে ধীরগতি বলতে পারেন।” 

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থা অনীহা বা ইচ্ছাকৃত ভুল করে আলামত নষ্টের অজুহাতে দায় সারতে চান।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ‘পানিতে ভেসে আসা মৃতদেহ, গন্ধ ছড়ানো মৃতদেহ- উদ্ধারের ঘটনায় হত্যার মতো আলামত থাকলেও গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ করে না সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অপরাধের ধরন চি‌হ্নিত না করেই তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থা প্রথমেই আলামত নষ্ট হয়েছে বলেই দায় সারতে ব্যস্ত হন।”

আলামত সংগ্রহে ব্যক্তিবিশেষে বৈষম্য দেখানোর অভিযোগের সঙ্গে একমত এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “মৃতদেহ সমাজের কোনও নামিদামি ব্যক্তির হলে তদন্তে গুরুত্ব বেড়ে যায়, কাজেও গতি থাকে।

“আর প্রান্তিক, দরিদ্র কোনও ব্যক্তি হলে ঘটে উল্টো ঘটনা। দায়সারাভাবে হয় তদন্ত। ব্যক্তিবিশেষে তদন্তে একেক রকম গুরুত্ব থাকলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক।”

আলামত হিসেবে যা যা সংগ্রহ করা হয়

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলামতের প্রধান উৎস তিনটি- সন্দেহভাজন ব্যক্তি, ঘটনাস্থল ও আশপাশ। বিভিন্ন ধরনের আলামত সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে আছে রক্ত, বীর্য, প্রস্রাব, লালা, বমি, চুল, হাত ও পায়ের ছাপ। মোবাইল ফোন, আংটি, মরদেহের আশেপাশের মাটির ছবিও আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ ঘটনায় ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন তদন্তে। 

আলামত সংগ্রহকারী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। তারা জানিয়েছেন, অনেক সময় পেশাদার অপরাধীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটিকে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চান। এজন্য আলামত সংগ্রহের সময় সচেতন হয়ে সব দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।

আলামত কেন নষ্ট হয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আলামত নষ্ট হয় বিষয়টা এমন নয়। অনেক সময় অপরাধীরাই নষ্ট করার চেষ্টা করে। অনিচ্ছাকৃতভাবেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত আড়ালে থেকে যায়। অনেক সময় ক্রাইম সিনে আসা উৎসুক জনতার কারণেও আলামত নষ্ট হয়।

থানা পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে না পারলেও ডিবি, সিআইডি বা পিবিআই কীভাবে পারে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অন্য তদন্তকারী সংস্থার আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। যা থানায় নেই। তারপরেও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব ঘটনা দেখার চেষ্টা করে থানা পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) একেএম হাফিজ আক্তার। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “অপরাধীরা তো আলামত নষ্ট করেই। সাধারণ মানুষও অতি উৎসাহী হয়ে হাত দিয়ে ধরে, আলামত নষ্ট হয়। সেজন্য অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তার সঠিক তথ্য পেতে বা তদন্ত করতে বিলম্ব হয়। আবার থানা পুলিশের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতিও কম আছ।”     

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ জাহিদুল আরেফিন জানিয়েছেন, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত- কোনোভাবে আলামত নষ্ট হলে সত্য উদঘাটন জটিল হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, “অনেক সময় কিছু মরদেহ মর্গে আসার আগেই আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অপ্রয়োজনীয় আলামতও পাই। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই বলেন না কেন, আলামত নষ্ট হলে সঠিক রিপোর্ট তৈরিতে বেগ পেতে হয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত