Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

রাস্তায় নাচ কেন নিষিদ্ধ করল কম্বোডিয়া 

কম্বোডিয়ায় যানবাহন থেকে মিউজিক্যাল হর্ন সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কম্বোডিয়ায় যানবাহন থেকে মিউজিক্যাল হর্ন সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

টানা ৩৮ বছর দাপটের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। এ সময় দেশটিতে বেশ সাফল্যের সঙ্গে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হন তিনি।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেহারা দেখার সৌভাগ্য সাবেক ওই জেনারেলের আমলে কম্বোডিয়ার জনগণের হয়নি। বিরোধীদের কারাবন্দি করা বা তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর চলে দমন-পীড়ন।

সোশাল মিডিয়ায় কম্বোডিয়ার নারীরা শর্ট স্কার্ট পরে হাজির হতে পারবে না- এ ফরমান যেমন স্বৈরশাসকের তকমা পাওয়া হুন সেন জারি করেন, তেমনি নারীদের শালীন পোশাক পরার নসিহতও তাকে করতে দেখা যায়।

সাত মাস আগে ৭০ বছর বয়সে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান হুন সেন। তার আগে কম্বোডিয়ার ‍প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি বসিয়ে যান তার বড় ছেলে হুন মানেতকে।

কম্বোডিয়ার জনগণ ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা হুন মানেত বাবার মতো হবেন না। হুন সেনের কায়েম করা স্বৈরশাসন থেকে দেশকে মুক্তি দেবেন, রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক বাতাবরণ থেকে মানুষকে বের করে আনবেন। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়ে বালি।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের ক্ষমতাকাল মাত্র সাত মাসের হলেও এরই মধ্যে তিনি নানাভাবে জানান দিয়েছেন, বাবা হুন সেনের দেখানো পথেই তিনি হাঁটবেন। বাবার শাসনের পরম্পরাই তিনি বজায় রাখবেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র সাত মাসের মাথায় হুন মানেত এমন কী করলেন, যা দেখে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে স্বৈরশাসনে পিষ্ট কম্বোডিয়ার মানুষ আশা হারিয়ে ফেলছেন?

নাচের ওপর খড়গহস্ত

কম্বোডিয়ার ট্রাকে এক ধরনের হর্ন থাকে, যেগুলো সাধারণ হর্ন নয়। এসব হর্ন থেকে গানও ভেসে আসে।

রাস্তায় চলাচলের সময় ট্রাক থেকে বেজে ওঠা গানের ছন্দে তাল মিলিয়ে নেচে ওঠা কম্বোডিয়ানদের সংস্কৃতির একটি অংশ।

এসব মিউজিক্যাল হর্ন কানে পৌঁছলেই তারা নাচানাচি শুরু করে দেন, বিশেষ করে কিশোর-তরুণরা। এটা করে তারা বেশ মজা পান। কোথায় নাচছেন, এটা মুখ্য বিষয় নয় তাদের কাছে। নাচতে পারলেই হলো।

ফেসবুকে এক ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বিশাল ট্রাক আসার জন্য রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছেন এক তরুণ কম্বোডিয়ান নারী। ট্রাকটি কাছাকাছি এলে এর চালক মিউজিক্যাল হর্ন বাজিয়ে দেন। হর্ন শুনে মৃদু হেসে গানের তালে নেচে ওঠেন ওই তরুণী। 

এভাবে রাস্তার ধারে নাচানাচি করা যে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, এ নিয়ে কম্বোডিয়ানরা মোটেই চিন্তিত নন।        

তাদের এই ঐতিহ্যের ওপর সম্প্রতি আঘাত হেনেছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, রাস্তার ধারে নাচানাচি একেবারেই বন্ধ।  

এজন্য ট্রাক থেকে মিউজিক্যাল হর্ন দ্রুত সরিয়ে ফেলার হুকুম দিয়েছেন হুন মানেত। এর পক্ষে ৪৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, যানবাহনের সুরেলা হর্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাস্তার ধারে তরুণদের নৃত্য তাকে বিরক্ত করে। এছাড়া এতে রাস্তাঘাটের শৃঙ্খলা ব্যাহত হয় এবং চালক ও নৃত্যরতদের জন্য ঝুঁকিরও সৃষ্টি হয়।  

প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের নির্দেশ মানতে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশ কম্বোডিয়ার সব ধরনের যানবাহন থেকে মিউজিক্যাল হর্ন সরাতে তৎপর হয়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষ।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত।

মিউজিক্যাল হর্ন যখন চক্ষুশূল

ক্ষমতাগ্রহণের সাত মাসের মাথায় কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের দৃষ্টি এতকিছু থাকতে কেন যানবাহনের মিউজিক্যাল হর্নের ওপর পড়ল, এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যানবাহন থেকে মিউজিক্যাল হর্ন সরানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের অস্বাভাবিক নীতির একটি হতে যাচ্ছে।

পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এই প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অনেকের ধারণা ছিল, কম্বোডিয়ার তরুণ সংস্কারপন্থী প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করবেন হুন মানেত।

এখন তারা দেখছেন, ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাবা হুন সেনের থেকে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে পারেননি হুন মানেত।

কম্বোডিয়ার গণপূর্ত ও পরিবহন মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারকে এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, সব ধরনের যানবাহন যেন পরীক্ষা করা হয়। সেগুলো থেকে মিউজিক্যাল হর্ন সরানো হয়েছে কি না, তা যেন নিশ্চিত করা হয়।

মিউজিক্যাল হর্নের জায়গায় যানবাহনে সাধারণ হর্ন বসাতে হবে, যেগুলো কেবল হর্ন দেয়।        

বুধবার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়ির আনুষঙ্গিক দোকানে মিউজিক্যাল হর্ন বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত অভিভাবকদেরও নির্দেশ দিতে ছাড়েননি। তিনি বলেছেন, অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে, তাদের সন্তানরা যেন রাস্তায় নেমে নাচানাচি না করে।     

কম্বোডিয়ার সরকারপন্থী পত্রিকা খমের টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাকের মিউজিক্যাল হর্নের সঙ্গে রাস্তায় নেচে উঠলে শিশুরা বিপদে পড়তে পারে। সেই বিবেচনা থেকে প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত এ পদক্ষেপ নিয়েছেন।

‘তুচ্ছ’ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন  

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সম্পর্কে দেশটির এক সমালোচক বলেন, যানবাহনে মিউজিক্যাল হর্ন ব্যবহার ও এর জেরে রাস্তায় নৃত্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত ‘নীতি গ্রহণের চেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণই’ বেশি করতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে।

হুন মানেত তার বাবা হুন সেনের ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ চালিয়ে যাবেন বলেই ধারণা ওই সমালোচকের।

মিউজিক্যাল হর্নের মতো ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে কেন প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে, এ প্রশ্ন তুলেছেন কম্বোডিয়ার এক ট্যাক্সিচালক। নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চালক বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর উচিত তার কাজ করে যাওয়া। তাকে এমন ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে কেন?”

কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। ছবি: এএফপি

হুন সেনের ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’

২০২০ সালে কম্বোডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সোশাল মিডিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা যেসব নারী (ইনফ্লুয়েন্সার) খোলামেলা পোশাক পরে বিজ্ঞাপনে হাজির হন এবং অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

খোলামেলা পোশাক পরিহিত ছবি বা ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হলে তা কম্বোডিয়ার নারীদের সম্মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন হুন সেন। এ কারণে নির্দিষ্ট ইনফ্লুয়েন্সারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

এছাড়া সোশাল মিডিয়ায় নারীদের শর্ট স্কার্ট পরাও নিষিদ্ধ করেছিলেন হুন সেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলে জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি নারীদের আবেদনময়ী পোশাক না পরার আহ্বান জানিয়েছি। তারা এখন আমার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।”                  

এর আগে ২০০৬ সালে কম্বোডিয়ায় সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ করেন হুন সেন। তার মতে, কম্বোডিয়ার উচিত, সৌন্দর্য প্রদর্শনীর চেয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণে বেশি জোর দেওয়া।

হুন সেন সে সময় বলেছিলেন, “আমরা এক সুন্দরী নারীকে প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে দাবি করতে পারি না, এটাই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি। আর এই দাবি করে তাকে সুইমিং স্যুট পরিয়েও দিতে পারি না।”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত