Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভোটের মাঠে অর্থ বিলাচ্ছেন মাস্ক, যুক্তরাষ্ট্রের আইন কী বলে

Elon_Musk_Trump_Money
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে সরাসরি প্রচারে নেমেছেন বিশ্বের শীর্ষধনী ইলন মাস্ক।

তিনি একটি পিটিশনে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে যারা ট্রাম্পকে ভোট দিতে চান, তাদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন।

পিটিশনটি তৈরি করেছে মাস্কের প্রচারাভিযান গ্রুপ আমেরিকা পিএসি, যা মূলত ট্রাম্পকে সমর্থন করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি তার কম্পানি টেসলার পলিটিক্যাল অ্যাকশন গ্রুপ।

মাস্ক ঘোষণা করেছেন, ওই পিটিশনে স্বাক্ষরকারীদের থেকে প্রতিদিন একজনকে ১০ লাখ ডলার করে দেওয়া হবে। এই একজনকে বাছাই করা হবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে।

গত শনিবার পেনসিলভেনিয়ার একটি টাউন হলে এই ঘোষণা দেন মাস্ক। শনিবারের সেই কর্মসূচিতে তিনি একজনকে এমন উপহার দিয়েছেনও। রবিবারও একজনকে উপহার দেওয়া হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনার মধ্যে এই অর্থ বিলাচ্ছেন মাস্ক।

তবে তার এই কর্মকাণ্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্কের এই কাজ নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন।

পেনসিলভেনিয়ার ডেমোক্রেটিক গভর্নর জোশ শাপিরো রবিবার এই বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

শাপিরো এনবিসির এক অনুষ্ঠানে বলেন, “নিবন্ধিত ভোটারদের মাস্কের টাকা দেওয়ার ঘোষণা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার। এটা এমন একটা বিষয় যেদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজর দিতে পারে।”

নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ রিক হ্যাসেন তার ব্যক্তিগত আইন ব্লগে লিখেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন মাস্কের প্রস্তাব ‘নিশ্চিতভাবে অবৈধ’।

যুক্তরাষ্ট্রে কোনও ভোটারকে ভোট দিতে বা নিবন্ধিত হতে প্ররোচিত করতে অর্থ প্রদান অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিচার বিভাগের নির্বাচন অপরাধ সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী, ভোটারকে শুধু নগদ অর্থ দেওয়াই নয়, আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় এমন কোনেও কিছু দেওয়াও, যেমন লিকার বা লটারিও নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে।

ইলন মাস্ক সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে নেমেছেন।

মাস্কের প্রস্তাব কী

মাস্ক ৭টি সুইং স্টেট— পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, নেভাডা, অ্যারিজোনা, মিশিগান, উইসকনসিন এবং উত্তর ক্যারোলাইনার ভোটারদের ‘বাক স্বাধীনতা এবং অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে ওই পিটিশন স্বাক্ষর করতে উৎসাহিত করছেন।

পিটিশনে লেখা হয়েছে, সংবিধানের “প্রথম এবং দ্বিতীয় সংশোধনী বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা এবং অস্ত্র বহনের অধিকার দেয়। আমি নিচে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে প্রথম এবং দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রতি আমার সমর্থন ব্যক্ত করছি৷”

অ্যামেরিকা পিএসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১০ লাখ ডলার উপহার পাওয়ার উপযুক্ত হতে পিটিশনে স্বাক্ষরকারীকে একজন নিবন্ধিত ভোটার হতে হবে।

যারা নিজেরা স্বাক্ষর করার পর অন্য কোনও ভোটারকে রেফার করবেন, তাদের প্রত্যেককে ৪৭ ডলার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

পাশাপাশি পেনসিলভেনিয়া রাজ্যে নিবন্ধিত কোনও ভোটার যদি পিটিশনে স্বাক্ষর করেন, তাহলে তাকে ১০০ ডলার করে দেওয়া হচ্ছে এবং একই রাজ্যে নিবন্ধিত আরেকজন ভোটারকে পিটিশনটি স্বাক্ষর করতে পাঠালেও ১০০ ডলার করে দেওয়া হচ্ছে।

এটা কি বৈধ

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক পল শিফ বারম্যান বলেছেন, “আমার বিশ্বাস, মাস্কের এই কাজ সম্ভবত অবৈধ।”

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইন বলে, কেউ যদি ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন ও অর্থ প্রদান করে, কিংবা অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দেয় বা গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে তার ১০ হাজার ডলার জরিমানা বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।

বারম্যান বিবিসিকে বলেন, “তার প্রস্তাবটি শুধু নিবন্ধিত ভোটারদের জন্য উন্মুক্ত, তাই আমি মনে করি তার প্রস্তাব এই আইন ভঙ্গ করছে।”

বিচার বিভাগ মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। মন্তব্যের জন্য ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের (এফইসি) সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।

এফইসির সাবেক চেয়ারম্যান ব্র্যাড স্মিথ বলেছেন, কৌশলটি একটি ফাঁক দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। কারণ কাউকে নিবন্ধন বা ভোট দেওয়ার জন্য সরাসরি অর্থ প্রদান করা হচ্ছে না।

ব্র্যাড স্মিথ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “তিনি তাদের ভোট দিতে নিবন্ধন করার জন্য অর্থ প্রদান করছেন না। তিনি একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করার জন্য তাদের অর্থ প্রদান করছেন। তবে তিনি চান যে, শুধু নিবন্ধিত ভোটাররাই পিটিশনে স্বাক্ষর করবে। তাই আমি মনে করি তিনি ঠিক আছেন।”

তবে নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একজন নির্বাচনী আইনের অধ্যাপক মাইকেল কাং বিবিসিকে বলেছেন, প্রেক্ষাপটটা গুরুত্বপূর্ণ।

মাইকেল কাং বলেন, “আমি কিছু বিশ্লেষণে বুঝতে পারি যে এটি বেআইনি নয়। কিন্তু আমি মনে করি এর প্রেক্ষাপটটিও মাথায় রাখতে হবে। স্পষ্টতই এমন একটি উপায়ে ভোট দেওয়ার জন্য লোকদের নিবন্ধন করতে প্ররোচিত করা হচ্ছে, যা আইনগতভাবে জটিলতার।”

নির্দলীয় ক্যাম্পেইন লিগ্যাল সেন্টারের আদাভ নোটি বলেছেন, মাস্কের স্কিমটি “ফেডারেল আইন লঙ্ঘন করে এবং বিচার বিভাগের দেওয়ানী বা ফৌজদারি প্রয়োগের বিষয়”।

আদাভ নোটি বিবিসিকে বলেছেন, “ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের বিনিময়ে অর্থ দেওয়া অবৈধ।”

নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ল-এর সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক জেরেমি পল বিবিসিকে এক ইমেইলে বলেছেন, মাস্ক একটি আইনি ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, প্রস্তাবটি বেআইনি হতে পারে এমন একটি যুক্তি রয়েছে, তবে এটি “আইন অনুসারে যা হওয়ার কথা তা পাওয়ার জন্যই এটি ডিজাইন ও টার্গেট করা হয়েছে”। এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, এনিয়ে আদালতে মামলা করা কঠিন হবে।

ডেমোক্র্যাটরা কী বলছেন

পেনসিলভেনিয়ার গভর্নর জোশ শাপিরো মাস্কের এই পদক্ষেপকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

জবাবে মাস্ক বলেন, শাপিরোর এমন কথাও ‘উদ্বেগজনক”।

বিলিয়নেয়ার বিনিয়োগকারী মার্ক কিউবান, যিনি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কমলা হ্যারিসের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন; তিনি বলেছেন, মাস্কের অফারটি ‘উদ্ভাবনী এবং মরিয়া’ উভয়ই।

তিনি সিএনবিসিকে বলেন, “আপনি শুধু এটি করেন, কারণ আপনি মনে করেন যে আপনাকে করতে হবে, কিন্তু সুইপস্টেক ব্যবহার করা কোনও খারাপ ধারণা নয়। এটি কাজ করবে কিনা, তা ভিন্ন বিষয়। এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে।”

অতীতে এমন কোনও নজির কি আছে

মাস্ক তার সমালোচনার জবাবে যুক্তি দিয়েছেন, ডেমোক্র্যাট এবং তাদের দাতারাও অতীতে অনুরূপ উদ্যোগে অর্থায়ন করেছে।

এক্সে তিনি একটি পোস্ট শেয়ার করেন যেখানে দাবি করা হয়েছে, মেটার বস মার্ক জাকারবার্গ ২০২০ সালে একই কাজ করেছিলেন।

জাকারবার্গ ২০২০ সালের নির্বাচনে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। তবে তা পোস্টাল ব্যালটের লজিস্টিকস সরবরাহে সহায়তার জন্য দুটি নির্দলীয় সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল। সরাসরি ভোটারদের দেওয়া হয়নি।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সমর্থকদের একত্রিত করার জন্য বিগত নির্বাচনে বিভিন্ন উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছে। যেমন ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ২৫ মিলিয়ন ভোটার নিবন্ধন ক্যাম্পেইন।

তবে সেই টাকাও সরাসরি ভোটারদের দেওয়া হয়নি। তহবিলটি এমন উদ্যোগের দিকে গিয়েছিল যা ভোটারদের নিবন্ধন করতে উৎসাহিত করেছিল। যেমন, ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটার নিবন্ধন করার জন্য লোক নিয়োগ এবং টেলিভিশন ও ডিজিটাল বিজ্ঞাপন দেওয়া।

অধ্যাপক কাং বলেন, “ভোটারদের নিবন্ধন করানোর জন্য লোক নিয়োগে অর্থ দেওয়া বৈধ, তবে আপনি নিবন্ধনের জন্য ভোটারদের সরাসরি অর্থ দিতে পারবেন না।”

ইলন মাস্ক

মাস্ক আর কী করেছেন

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় মাস্কের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু মাস্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন।

২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে মাস্ক ঘোষণা করেন যে, তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টি ছেড়েছেন এবং তার অনুসারীদের রিপাবলিকানদেরককে ভোট দিতে উৎসাহিত করেন।

এ বছর তিনি নিজেকে আমেরিকান রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত করেছেন, যেমনটি আগে কখনও হয়নি। বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান প্রার্থীর তহবিলে অনুদান দিয়েছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন জানিয়ে পোস্ট করেছেন।

গত সপ্তাহের মন্তব্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের বেশিরভাগ অংশকে ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড চলচ্চিত্রের সমতুল্য বলে বর্ণনা করেছেন।

মাস্ক ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারণায় সমর্থন করার লক্ষ্যে জুলাই মাসে আমেরিকা পিএসি গঠন করেছিলেন। তিনি এখন পর্যন্ত গ্রুপটিতে অন্তত ৭৫ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন।

আমেরিকা পিএসি-র ওয়েবসাইট বলা হয় যে, তারা ‘সুরক্ষিত সীমান্ত’, ‘নিরাপদ শহর’, ‘স্বাধীনতা’, ‘বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ব্যয়’, একটি ‘ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা’ এবং ‘আত্ম-সুরক্ষা’ চায়।

ট্রাম্প রবিবার বলেন, তিনি মাস্কের অর্থ উপহার দেওয়ার বিষয়টি খেয়াল করেননি, তবে তাকে বন্ধু হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মাস্ক প্রথমবারের মতো প্রচারাভিযানে উপস্থিত হয়েছেন, প্রথমে ট্রাম্পের পক্ষে এবং এরপরে টাউন হলে নিজে একাই উপস্থিত হয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পও আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারলে ব্যবসায়ী ইলন মাস্ককে সরকারের ‘এফিশিয়েন্সি কমিশন’-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, ডয়চে ভেলে

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত