সোমালি জলদস্যুরা যখন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠছিল, তখনও এর ব্রিজেই ছিল নাবিকরা। কেউ কেউ সেই দৃশ্য ভিডিও করছিল, যেখানে শোনা যাচ্ছিল- ‘স্যার, আসছে আসছে, উঠে পড়ছে, গান (বন্দুক) আছে’।
তাতে বোঝা যাচ্ছে, ১২ মার্চ জিম্মি হওয়ার আগে বাংলাদেশি জাহাজটির নাবিকরা ব্রিজে বসেই দস্যুদের তৎপরতা দেখছিল। দস্যুদের প্রতিরোধের কোনও তৎপরতাও ছিল না।
অথচ তা হওয়ার কথা না, জলদস্যু আক্রমণের আভাস পেলে প্রতিরোধ করতে না পারলে সব নাবিকেরই জাহাজের সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়ার কথা।
সিটাডেল কী
দস্যুতা, হাইজ্যাক বা ডাকাতির মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে প্রাণে রক্ষা পেতে বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকরা জাহাজের নির্দিষ্ট একটি গোপন কক্ষে লুকিয়ে পড়েন, যাকে নাবিকের ভাষায় ‘সিটাডেল’ বা দুর্গ বলে। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সিকিউরিটি অনুযায়ী, এই কক্ষটি অসম্ভব সুরক্ষিত। জাহাজের নিচের বিশেষ স্থানে কক্ষটি এমনভাবে নকশা করা, যেখান থেকে পুরো জাহাজটি তদারকও সম্ভব। সেই কক্ষ থেকেই বন্ধ করা যায় জাহাজের প্রধান এবং বিকল্প ইঞ্জিন। সেই কক্ষে বসেই ভিএসএফ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ আছে। বাথরুম থেকে শুরু করে নির্ধারিত পরিমাণ খাবার-দাবার, পানির মজুদ, এমনকি জরুরি ওষুধও থাকে সিটাডেলে।মুলত বিপদের সময় নাবিকদের সুরক্ষা দিতেই জাহাজ নির্মাণের সময় ‘সিটাডেল’ তৈরি করে রাখা হয়। এই কক্ষটি প্রথমত গোপন থাকে, যাতে সাধারণ কেউ সহজে সেই কক্ষের হদিস না পায়। আবার অসম্ভব সুরক্ষিত করেই নির্মিত করা হয়, যাতে কেউ খুঁজে পেলে গুলি করে বা ভেঙেও সেই কক্ষে ঢুকতে না পারেন। দস্যু আক্রমণ হলে উদ্ধারকারী জাহাজ না আসা পর্যন্ত সিটাডেলে লুকিয়ে থাকার সুযোগ থাকে।
মার্চেন্ট মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দস্যুতা আক্রান্তের বিষয়টি আঁচ করার সাথেই সাথেই নাবিকরা সিটাডেলে চলে গিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখেন। তার আগেই জাহাজের ইঞ্জিন শাটডাউন করে দেন। আর সুরক্ষিত সেই কক্ষে গিয়েই আশপাশের কোস্টগার্ড, টহল বাহিনীকে জরুরি বার্তা পাঠান; যাতে তাদের উদ্ধার করা হয়। টহল বাহিনী দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত জাহাজে পৌঁছা পর্যন্ত নাবিকরা সেখানে সুরক্ষিত থাকেন।”
সিটাডেল একেক জাহাজের নকশায় একেক রকম করা হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “ফলে দস্যুরা জাহাজে উঠে খোঁজাখুজি করতে থাকবে, কিন্তু নাবিকদের সন্ধান পাবে না বা খুঁজে পেতে দেরি হবে। আর তার আগেই টহল বাহিনীর জাহাজ উদ্ধারে ঘটনাস্থলে চলে এলে দস্যুরা আর খুব সুবিধা করতে পারে না। কারণ ইঞ্জিন বন্ধ থাকা জাহাজে দস্যুদের কিছুই করার থাকে না।”
আক্রান্ত হওয়ার সময় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা সেই সিটাডেল কেন ব্যবহার করেননি- তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
মাস্টার মেরিনাররা বলছেন, আবদুল্লাহ জাহাজটি যখন দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন একেবারে দিনের বেলা। সময়টা তখন সকাল সাড়ে ১০টা। আর চলার পথে সাগরের ভিজিবিলিটি পুরোপুরি পরিষ্কার ছিল। সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছিল, দস্যুরা জাহাজের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু নাবিকরা তখন মাংকি আইল্যান্ডে (জাহাজের ব্রিজের ওপরের অংশে থাকা খোলা অংশ) দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিল! এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক!
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান জিম্মি হওয়ার দিন অর্থাৎ ১২ মার্চ একটি অডিও রেকর্ড পাঠান জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কাছে।
তাতে তিনি বলেন, “মঙ্গলবার সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টা এবং জিএমটি (গ্রিনউইচ মান সময়) সময় ৭টা ৩০ এর সময় একটা হাইস্পিড স্পিড বোট আমাদের দিকে আসতেছিল। সাথে সাথে অ্যালার্ম দিচ্ছিল। আমরা সবাই ব্রিজে (যেখানে বসে ক্যাপ্টেন জাহাজ পরিচালনা করেন) গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটাডেলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল।”
নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশি একজন সিনিয়র মাস্টার মেরিনার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অডিও রেকর্ড যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে বাকি নেই যে নাবিকদের সবাই সিটাডেলে যায়নি।
“দুজন সিটাডেলে না গিয়ে বাকি ২১ জন সিটাডেলে লুকিয়ে তো কোনও লাভ নেই। সিটাডেল তৈরিই করা হয়েছে এই ধরনের বিপদে নাবিকদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। আমরা প্রশিক্ষণে এটাই শিখেছি, শিখিয়েছি, কিন্তু এখানে কাজে তো বাস্তবায়ন হতে দেখলাম না।”
সিটাডেলে সবাই না গেলে কী হয়- প্রশ্নে তিনি বলেন, “একজন নাবিকও যদি বাইরে থাকে, তাহলে সিটাডেলের উদ্দেশ্য সফল হবে না।
“আপনাকে বুঝতে হবে, দস্যুদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে জাহাজে থাকা নাবিক। নাবিককে জিম্মি করেই মুলত দস্যুরা মুক্তিপণ আদায় করবে। এখন দুজন নাবিক যদি বাইরে থাকে, তাহলে তো কোনও সুফল মিলবে না।”
মেরিন একাডেমি থেকে সদ্য পাস করা একজন নাবিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জাহাজের নিজস্ব রাডার দিয়ে সামনের পাশের ৯৬ নটিক্যাল মাইল দুর পর্যন্ত কী হচ্ছে, না হচ্ছে, সবই দেখা যায়। আর খালি চোখে একজন নাবিক তো ২০-২৫ নটিক্যাল দেখেন। আর এআইএস সিস্টেমে ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দেখা যায়।
“ঘটনাটি ঘটেছে দিনে-দুপুরে, আকাশ পরিষ্কার ছিল। ফলে এতদূর থেকে নাবিকরা নিশ্চয়ই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাহলে দস্যুতা ঠেকাতে বা নিজেদের সুরক্ষা দিতে প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় ছিল। কিন্তু নাবিকরা সেটি করেননি কেন?”
বিষয়টি জানতে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের মালিক কোম্পানি এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি নাবিকদের উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত বলে জানানো হয়েছে।
এর আর শিপিং যে শিল্পগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, সেই কবির গ্রুপ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য মিজানুল ইসলামকে মুখপাত্র ঠিক করেছে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটি আসল তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। আমরা এখন নাবিক উদ্ধারকেই প্রধান ফোকাস করেছি।”
২৩ নাবিককে জিম্মি করে জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহকে বৃহস্পতিবার সোমালিয়া উপকূলে ভিড়িয়েছে। নাবিকরা সুস্থ আছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে নাবিকদের ছাড়িয়ে আনতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন।
এক যুগ আগে বাংলাদেশের আরেকটি জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। ৯৯ দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে সেই জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার করা হয়েছিল।
এদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, বাংলাদেশি জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়ার খবর পেয়ে সেদিকে ছুটে গিয়েছিল ভারত মহাসাগরে মোতায়েন একটি টহল নৌযান এবং একটি রণতরী।
ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র সোশাল মিডিয়া এক্সে এক পোস্টে জানায়, ১২ মার্চ সন্ধ্যায় এমভি আবদুল্লাহকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তবে জাহাজে থাকা নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও কোনও সাড়া পায়নি।
অস্ত্রধারী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি নাবিকদের কোনও ধরনের ক্ষতি এড়াতে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজটি কোনও তৎপরতা চালায়নি। তবে সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটি ১৪ মার্চ ভেড়া পর্যন্ত একে চোখে চোখে রাখা হয়েছিল বলে ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে।
তারা এক্সহ্যান্ডেলে একটি ছবিও দিয়েছে, যেখানে এমভি আবদুল্লাহর মাংকি ব্রিজে সশস্ত্র চারজন সন্দেহভাজন জলদস্যুকে দেখা গেছে।