সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের জন্য মুক্তিপণ দেওয়া হবে, না কি সামরিক অভিযানে মুক্ত করা হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে দোলাচল।
এতদিন মুক্তিপণ দিয়ে নাবিক উদ্ধারের পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশি জাহাজটির মালিক পক্ষ বলে এলেও সোমবার তা ভিন্ন মোড় নিয়েছে অভিযানের খবরে।
সোমালি দস্যুদের হাতে তিন মাস ধরে জিম্মি থাকা আরেক জাহাজ ‘রুয়ান‘ থেকে সব নাবিকদের জীবিত ও অক্ষত উদ্ধার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
৪০ ঘণ্টার সফল সেই অভিযানের পর এমভি আবদুল্লাহকেও উদ্ধার করতে চাইছে ভারতীয় নৌবাহিনী। সেই অভিযানে সর্বাত্নক সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত নিয়েছে সোমালিয়ান পুলিশ গার্ড।
তাদের এই পরিকল্পনার খবর রয়টার্স প্রকাশ করার পর নতুন করে আলোচনা চলছে উদ্ধারের প্রক্রিয়া নিয়ে।
জাহাজের মালিক পক্ষ কবির গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, তারা অভিযানের পক্ষে নয়। আর এই অভিযান নিয়েও তারা কিছুই জানেন না।
“আমাদের প্রধান লক্ষ ২৩ নাবিককে জীবিত, অক্ষতভাবে উদ্ধার করা এবং তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনা। এজন্য বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ চলছে।”
এক যুগ আগে কবির গ্রুপেরই আরেকটি জাহাজ জাহান মনি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। তখন মুক্তিপণ দিয়ে ৯৯ দিন পর ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল জাহাজটিসহ নাবিকদের।
এমভি আবদুল্লাহ এক সপ্তাহ আগে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেও এখনও মুক্তিপণের জন্য জলদস্যুদের যোগাযোগের খবর পাওয়া যায়নি। জিম্মিকারী দস্যুদের কাছ থেকে কী দাবি আসে, তার অপেক্ষায়ই আছে মালিক পক্ষ।
মালিক পক্ষ রাজি না হলে সামরিক অভিযানের কথা আসছে কেন? সেই প্রশ্ন তুলছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রুয়েন উদ্ধারে দস্যুদের যেমন আটক করা হয়েছে, তেমনি নাবিকরা অক্ষত উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু রুয়েনের সাথে আবদুল্লাহ জাহাজের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।”
রুয়েন জাহাজটি মাল্টার পতাকাবাহী, জাহাজের নাবিকদের নয়জন বুলগেরিয়ার, সাতজন মিয়ানমারের এবং একজন এঙ্গোলার নাগরিক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাহাজটি ভারত মহাসাগরের একই এলাকা থেকে ছিনতাই করে সোমালি দস্যুরা।
ছিনতাইয়ের পর দস্যুরা মুক্তিপণ দাবি করলেও তিন মাসে সেই অর্থ মেটাতে রাজি হয়নি মাল্টা সরকার কিংবা নাবিকদের কেউই। এই অবস্থায় দস্যুরা সেই জাহাজটি নিয়েই নতুন ছিনতাই পরিকল্পনা কষে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত শনিবার সোমালিয়ার গারাকাদ উপকূল থেকে রুয়েনকে নিয়ে নতুন ছিনতাইয়ের লক্ষ্যে বেরিয়েছিল বলে খবর মিলেছে।
ক্যাপ্টেন আনাম বলেন, “রুয়েন জাহাজের বিপরীতে বাংলাদেশি জাহাজ আবদুল্লাহ’র মালিক পক্ষ তো শুরু থেকেই বলে আসছে জাহাজের নাবিকদের জীবিত নিরাপদে ফিরিয়ে আনাই প্রথম লক্ষ। এজন্য মুক্তিপণ দিতে তারা রাজি।
“বাংলাদেশ সরকার এখনও নাবিকদের ফিরিয়ে আনাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে দুই জাহাজের প্রেক্ষিত ভিন্ন। এজন্যই আবদুল্লাহ জাহাজে সামরিক অভিযান চালানোর প্রয়োজন নেই। আর এখন সেটি সম্ভব না।”
গত দুদিন ধরে জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে পরিবারের কোনও যোগাযোগ হয়নি। ফলে সমাধানের বিষয়টি অভিযানের দিকে মোড় নিচ্ছে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে নাবিকদের স্বজনদের।
এর আগে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের নির্মুলে কাজ করা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ‘অপারেশন আটালান্টা’র পক্ষ থেকে আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তাতে বাংলাদেশ সরকার সাড়া দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান খুরশেদ আলম জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ২৩ নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই অভিযানের ওই প্রস্তাবে সরকার ও মালিক পক্ষ রাজি হয়নি।
এদিকে আবদুল্লাহকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে তিন বার জাহাজটির স্থান পরিবর্তন করেছে জলদস্যুরা।
কবির গ্রুপের কোম্পানি এসআর শিপিংয়ের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে।
জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে। নাবিকরা সবাই বাংলাদেশি। জাহাজটি এখন সোমালিয়ার গদজিরান উপকূল থেকে ৪ মাইল দূরে সাগরে দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।