‘এটা নতুন জীবন।’ কেউ দেড় বছর আবার কারও পাঁচ বছরের বেশি সময় কেটেছে মিয়ানমারের কারাগারের পেছনে। প্রত্যেকের জীবনে আছে এক দুর্বিষহ গল্প। সেখান থেকে দেশে ফেরাটা তাদের জন্য এক নতুন জীবনের মতোই।
নানা অপরাধে মিয়ানমারের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ শেষে দেশে ফিরেছেন তিন নারীসহ ১৭৩ বাংলাদেশি। তাদের বেশিরভাগই দালালের প্রলোভনে পা বাড়িয়েছিল মালয়েশিয়ার পথে। কিন্তু ওই দালালরা ট্রলারে করে তাদের নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল মিয়ানমারে।
সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে সীমানা পেরিয়ে যাওয়া জেলেরাও রয়েছেন এই তালিকায়। ৩ নারীসহ কয়েকজন আবার আটক হন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে। এমন নানা অপরাধে মিয়ানমারে কারাভোগ করা বাংলাদেশিরা বলছেন, দেশে ফিরতে পারবে পারবে কিনা এমন অনিশ্চয়তায় দিন কেটেছে তাদের। তাই দেশে ফেরাটাই নতুন জীবন।
মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা ১৭৩ বাংলাদেশিকে নিয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ছোট একটি জাহাজ (ডক জাহাজ) কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বাঁকখালী নদীর ঘাটে এসে পৌঁছে বুধবার দুপুর দেড়টা নাগাদ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিয়ানমার প্রতিরক্ষা বাহিনীর ‘নেভাল শিপ চিন ডুইন’ জাহাজে করে এসব বাংলাদেশিকে নিয়ে বিজিপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার জলসীমায় অবস্থান নেন। যেখান থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ছোট জাহাজ তাদের নিয়ে আসেন।
ফেরত আসা ১৭৩ জনের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ১২৯ জন, বান্দরবান জেলার ৩০ জন, রাঙ্গামাটি জেলার সাতজন, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার একজন করে রয়েছেন।
দেশে ফিরে কারাগারে
ফেরত আসা ১৭৩ জন ঘাটে আসার পরই তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিজিবি, পুলিশ, প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা মিলে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। অধিকাংশকেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও কয়েকজনকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য কোথাও। তবে এ বিষয়ে উপস্থিত কোনও কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম জানান, ফেরত আসা বাংলাদেশিদের বিজিবি গ্রহণ করে পুলিশকে হস্তান্তর করেছে। যাচাই-বাছাই শেষে অনেককে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আইনগত জটিলতার কারণে অনেককে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।
আইনগত জটিলতার বিষয়ে তিনি বলেন, “ফেরত আসা কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। বিষয়টি এখন যাচাই-বাছাই চলছে। পরে বিস্তারিত জানা যাবে।”
জাতীয় সংসদের হুইপ ও কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, “সরকারের প্রচেষ্টায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।”
‘ছেলে পেয়ে যেন স্বর্গ পেলাম’
ফেরত আসা ১৭৩ জনের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার দুই ভাই মো. সাইফুল ও মো. ইসহাক।
সাইফুল আর ইসহাককে গ্রহণ করে মা রেদওয়ান বেগম বলেন, “দুই ছেলে পেয়ে যেন স্বর্গ ফিরে পেলাম।”
২০২২ সালের ১৫ মার্চ নাফ নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়ে ১৮ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। ৪ মাস পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ৪ জনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে তারা। বাকি ১৪ জন বন্দি ছিলেন মিয়ানমারের কারাগারে। সাইফুল ও ইসহাকসহ তাদের ১১ জন ফিরলেন এই ১৭৩ জনের দলে। এখনও বন্দি থেকে গেলেন ৩ জন।
সাইফুল ও ইসহাক জানান, সেদিন নাফ নদীতে ৪টি নৌকায় মাছ শিকারে গেছিলেন তারা। ১৮ জেলেকে মিয়ানমার বিজিপির একটি বিওপিতে আটকে রেখে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। কিন্তু টাকা না দেয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এখনও যে তিনজন ফিরতে পারেননি তারা হলেন- সুলতান, মহিউদ্দিন ও রফিক। যাচাই-বাছাইকালে তাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলা হয়নি তাই তারা ফিরতে পারেননি।
ফেরত আসা বাংলাদেশিদের তালিকায় ছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুর থানার বাসিন্দা হামজা (৩৫)। বাঁকখালীর জেটিঘাটে হামজাকে নিতে এসেছিলেন বড় ভাই মানিকুল ইসলাম ও আবু তালহা।
আবু তালহা জানান, পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট হামজা মানসিক ভারসাম্যহীন। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে সে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। এর পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। কয়েক দিন আগে নীলফামারী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জানতে পারি হামজা মিয়ানমারে কারাগারে বন্দী। ফেরত আনা হচ্ছে কক্সবাজারে। ভাইকে ফেরত পেয়ে খুশি দুই ভাই।
একই জায়গায় কথা হয় রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের আয়ুব আলীর ছেলে নবী হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার ভাই জাগির হোসেনসহ এলাকার ৪ জন ফিরছেন। পুলিশ এতথ্য জানানোর পর ঘাটে নিতে এসেছেন। গত দেড় বছর আগে পরিবারকে কিছু না বলেই নিখোঁজ হন তার ভাই। ১ মাস পরে জানতে পারেন দালালের প্রলোভনে সাগর পথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে মিয়ানমারের আটক হন তারা। দেড় বছর পর ভাই ফিরবেন এতেই খুশি নবী হোসেন।
মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুরের বদিউল আলমের ছেলে জয়নাল আবেদীনও দেড় বছর আগে একইভাবে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে নিখোঁজ হন। একইভাবে নিখোঁজ হন ওই এলাকার ৫ জন।
অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়ার পথে গিয়েই বেশিরভাগ মিয়ানমারে আটক হয়েছিলেন বলে জানান ঘাটে আসা স্বজনরা।
মিয়ানমারে ফিরবেন ২৮৫ জন
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার সেনা-বিজিপির ২৮৫ জন নিজ দেশে ফেরত যাবেন বৃহস্পতিবার। তারা ফেরত যাবেন বাংলাদেশিদের ফেরত আনা জাহাজে করেই। মিয়ানমারের ২৮৫ সদস্যকে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল গেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি।
এর আগে ফেব্রুয়ারির শুরুতে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৩৩০ জন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের সবাইকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। প্রথম দফায় ফেরতের সময় ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করতে দিয়ে সংশ্লিষ্টরা কথা বললেও, এবার তা হচ্ছে না।