মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিয়েছে নাটকীয় মোড়। ১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সেনা শাসকদের আর কখনও এমন নাজুক অবস্থায় পড়তে দেখা যায়নি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর থেকে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল জান্তা।
কিন্তু গত অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হামলার মুখে পতনের শঙ্কায় রয়েছে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সরকার। একের পর এক শহর ও অঞ্চলের দখল নিচ্ছে বিদ্রোহীদের জোট। সবশেষ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী চিন রাজ্যের ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর পালেতোয়া দখলের দাবি করেছে বিদ্রোহীরা। জান্তার বাহিনীতেও বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। সংখ্যালঘু জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংখ্যাগুরু বামারদের জোট গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, যা দেশটিতে সামরিক শাসনের অবসানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি
ব্রিটিশ উপনিবেশকাল থেকেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলো বিদ্রোহ শুরু করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটিশ শাসন দেশটিতে অল্প সময়ের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনে।
এতে মিয়ানমারের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই উত্তেজনা আরও তীব্র হয়। ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কয়েকটি মিত্রশক্তি আর অন্যরা জাপানিদের সঙ্গে জোট বাঁধে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার পর মিয়ানমারের নতুন সরকারও রাষ্ট্র পরিচালনায় সব নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি। বামার সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার দেশটির অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অবহেলা শুরু করে। বামারদের বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের মতো সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারে জাতিগত বিদ্রোহের এক দীর্ঘ যুগের সূচনা করে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয় মিয়ানমার। এর পর থেকেই বিভিন্ন অধিকারহীনতা ও বৈষম্যের শিকার জাতিগোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভের প্রকাশ দেশটিতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে।
মিয়ানমারের জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই বামার। তাদের একেচেটিয়া আধিপত্য দেশটির সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র। এতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জনরোষ থেকে দেশটিতে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
মিয়ানমারের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সান দেশটির সংখ্যালঘু অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় সমর্থন চেয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতার পর তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু স্বাধীনতার আট মাস আগে জেনারেল অং সান তার কয়েকজন কাউন্সিল সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
স্বাধীনতার পর প্রতিশ্রুত স্বায়ত্তশাসন না পেয়ে অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলো সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। স্বাধীনতার পরের দশকে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছোটবড় সংঘাত লেগেই ছিল।
সামরিক শাসনে সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি
স্বাধীনতার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ নু’র নেতৃত্বে মিয়ানমারে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু জাতিগত সংঘাত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হয় দেশটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনীকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
পরের দুই বছর সরকারের নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান জেনারেল নে উইন। এরপর ১৯৬০ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পর উ নু’র নেতৃত্বে আবারও একটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সেই সরকারও অস্থিরতা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।
বেসামরিক সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে সরাসরি ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ৫০ বছর ধরে দেশটিতে সেনাশাসন চলছে।
ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও সংখ্যাগুরু বামারদের ও বার্মিজ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এতে জাতিগত বিভাজন আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
জেনারেল নে উইন বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করে মিয়ানমারের ওপর সর্বগ্রাসী একদলীয় শাসন চাপিয়ে দেন। দলটি বার্মিজ ওয়ে টু সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্রের বার্মিজ ধরন নামের শাসন ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা। অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণের মাধ্যমে সোভিয়েত-স্টাইলের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম, ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও সংস্কারগুলোর সমন্বয় করা হয়।
সামরিক শাসনের দমন-পীড়নের কারণে মিয়ানমারের আরও কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে। ফলে দেশটির সামনে চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যায়। তবে সেনাশাসকরা বিভিন্নভাবে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকে। মাঝেমধ্যে তারা এক বা একাধিক পক্ষের সঙ্গে অস্ত্রসংবরণ চুক্তি করে অন্য পক্ষকে দমন করত। সশস্ত্র সংঘাত মিয়ানমারের রাষ্ট্রজীবনের একটি স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয়।
গত ৭৫ বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই কোনও না কোনও বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত চালিয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম
১৯৮০-র দশকের শেষদিকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল অং সানের কন্যা অং সান সু চি দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই শুরু করেন। সু চির আগমনে দেশটির রাজনীতিতে নবজোয়ার সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট সামরিক সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মিয়নমারে ব্যাপক গণবিদ্রোহ শুরু হয়।
এই গণবিদ্রোহ ইতিহাসে ‘৮৮৮৮ বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলে এই গণবিদ্রোহ, যা ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এক রক্তক্ষয়ী সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দমন করা হয়।
এবার সেনাবাহিনীর নতুন একটি গ্রুপ স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রিস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) গঠন করে ক্ষমতা দখল করে। এসএলওআরসি মূলত বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টিরই ভিন্ন একটি রূপ।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অং সান সু চি গণতন্ত্রের প্রতীকে পরিণত হন। ১৯৯০ সালে সামরিক জান্তা নির্বাচনের আয়োজন করে। সেই নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৮১ শতাংশ ভোট পান। কিন্তু সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় মোট ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন সু চি।
সু চিকে বন্দি করা হলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে। তবে এই সংগ্রাম কর্তৃত্ববাদী শাসনের তীব্র প্রতিরোধের মুখে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। ২০১০ সালে সু চির জীবনী নিয়ে বানানো সিনেমা ‘দ্য লেডি’ দেখে বিশ্বজুড়ে তার মুক্তির দাবি উঠে।
সামরিক জান্তা অবশেষে সু চিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং সে বছরের শেষ দিকে নির্বাচনের আয়োজন করে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে একটি আধা-সামরিক ধরনের সরকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পায়।
তবে সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও দেশটির ক্ষমতার কলকাঠি সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। ফলে টানাপোড়েন অব্যাহত থাকে। ২০১৫ ও ২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিশাল বিজয় পায়। এতে সামরিক জান্তা ও জান্তাবিরোধীদের মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশটিতে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
কিন্তু ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো বিভিন্ন ঘটনায় সেই প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী ফের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে। এনএলডির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং অং সান সু চিকেও আটক করা হয়। এরপর দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে সু চিকে ৩৩ বছর কারাদণ্ড দেয় জান্তা।
গৃহযুদ্ধ থেকে জনযুদ্ধ
ক্ষমতাচ্যুত এনএলডি নেতারা ২০২১ সালের এপ্রিলে সামরিক শাসনবিরোধী শক্তিগুলোকে নিয়ে পাল্টা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে। এই সরকারের সশস্ত্র সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) গঠন করা হয় একই বছরের মে মাসে। সেই থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে দেশটিতে।
মিয়ানমারের এবারের গৃহযুদ্ধের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো– এই প্রথম দেশটির প্রধান নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বামাররা গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। গণতন্ত্রকামী বামাররা বিদ্রোহী অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও জোট গড়ে তুলেছে। এক ডজনের বেশি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই গণতান্ত্রিক জোটে যোগ দিয়েছে। ফলে এবার এক সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধের কবলে পড়েছে দেশটি। বর্তমানে দেশটির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় গৃহযুদ্ধ চলছে।
পিডিএফ ও বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত শক্তি দেশটির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তবে এই লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তি দেশটির গণতন্ত্রকামী বামার তরুণরা। বামাররা এর আগে আর কখনও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি। বামারদের অংশগ্রহণে এই যুদ্ধ জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। ফলে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনা শাসকরা দেশজুড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে।
মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে দেশটির ক্ষমতা দখলকারী সেনাবাহিনী প্রথম থেকেই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী সেই অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষদিকে তিনটি বড় জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে একযোগে হামলা শুরু করলে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এই তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী হলো- টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)। এদেরকে একত্রে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলা হয়। তাদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য জাতিগত বিদ্রোহী, মিলিশিয়া গোষ্ঠী ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে।
চারদিক থেকে বিদ্রোহীদের একযোগে হামলার ফলে জান্তার বাহিনী বেশ কয়েকটি বড় পরাজয়ের মুখে পড়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, বিদ্রোহীরা অন্তত পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি, ৩০০-র বেশি ছোট সেনা চৌকি ও বেশ কয়েকটি বড় শহর দখল করেছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ পথটিরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ভারী অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদও বিদ্রোহীরা জব্দ করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সি লিখেছেন, বিদ্রোহীদের এই বিজয়গুলো ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যা সম্ভবত ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর মিয়ানমারের কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাত। এতে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বড় ধরনের কৌশলগত এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা যুদ্ধের কারণে মিয়ানমারের সংঘাত এতদিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্ব পায়নি। বিদ্রোহীদের অব্যাহত অগ্রগতিতে সেই সংঘাত এখন প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনাম হচ্ছে।
জান্তার পতন কি আসন্ন
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মিয়ানমারের সেনা সরকারের পতন আসন্ন বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২২ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অবশেষে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে উৎখাতের আশা জেগেছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দরকার বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রস্তুত হতে বলেছে। সিএফআর এর একজন বিশ্লেষকের ভবিষ্যদ্বাণী হলো, দেশজুড়ে যে ঝড় বইছে, তাতে ভেঙে পড়বে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবিলম্বে প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ। কিছু পর্যবেক্ষক আরও সামনে বেড়ে বলেছেন, গৃহযুদ্ধের পরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কী হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনারও সময় হয়ে গেছে। কেউ আবার জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের কথা বলছেন।
তবে পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সসহ (পিডিএফ) মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর অগ্রগতি অব্যাহত থাকলেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে। তথাপি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তারা এক অভুতপূর্ব সহযোগিতা দেখিয়েছে। এর ফলে তারা দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাজুড়ে যৌথ ও সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করতে পারছে এবং নাটকীয় সাফল্য অর্জন করছে।
মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের মধ্যে এমন নজিরবিহীন সহযোগিতা সামরিক জান্তার জন্য সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। একসঙ্গে সব জায়গায় শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখা বা একই সময়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় বড় অভিযান চালানোর জন্য সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। আবার ভ্রাম্যমাণ স্ট্রাইক ফোর্সগুলোকে প্রধান যুদ্ধ স্পটগুলোতে পাঠানোর পর অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো বিদ্রোহীদের আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। এতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দূর্বলতাও ধরা পড়ছে।
তবে গ্রিফিথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু সেলথ বলেছেন, এবার মিয়ানমারের সামরিক জান্তার চুড়ান্ত পতন ঘটবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী এখনই করা ঠিক হবে না। কারণ মিয়ানমারে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা কী তা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র নেই। সবই মূলত অনুমান। বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হামলায় সামরিক জান্তা নিঃসন্দেহে গুরুতরভাবে দুর্বল হয়েছে। তবে শিগগিরই তার পতন ঘটার সম্ভাবনা নেই। বিদ্রোহীদের অব্যাহত অগ্রগতিতে সামরিক জান্তার বাহিনী উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে সত্য, কিন্তু তা জান্তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেনি।
মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক অ্যান্থনি ডেভিস এশিয়া টাইমসে লিখেছেন, জান্তার হাতে আর ভালো কোনো বিকল্প নেই। তবে তার মানে এই নয় যে, এই পরাজয়ের পর তাদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। অতীতেও মিয়ানমারের জেনারেলরা বিস্ময়কর বাস্তববাদিতা এবং সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার সক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাদের সেই শক্তির অবমূল্যায়ন করা উচিৎ হবে না।
সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল লিন্টনার লিখেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনও বেশ শক্তিশালী, অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত। সেনা সদস্যদেরকেও হাইকমান্ডের প্রতি এখনও যুক্তিসঙ্গতভাবে অনুগত বলেই মনে হচ্ছে। তাদের মধ্যে সংহতিও ঠিক আছে। অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা এবং অন্যান্য সমস্যা রয়েছে তা সত্য। কিন্তু শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো কোনো লক্ষণ বা অমীমাংসিত কোনো মতবিরোধের চিহ্নও দেখা যায়নি।
অ্যান্ড্রু সেলথ লিখেছেন, সময় এখন বিদ্রোহীদের অনুকুলে থাকলেও তা জান্তার পক্ষেও চলে আসতে পারে। কারণ অর্থনৈতিকভাবে জান্তা সরকার এখনও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, যা পিডিএফ ও জাগিতগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নেই। এছাড়া জান্তাকে রক্ষা এবং তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতি মেটানোর জন্য চীন ও রাশিয়ার মতো মিত্র রয়েছে। অন্যদিকে, জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো ও জাতীয় ঐক্যের সরকার এখনও অনেক বিচ্ছিন্ন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং অনেক বিষয়ে বিভক্ত।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক অধ্যায়ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অ্যাডাম সিম্পসন ইস্ট এশিয়া ফোরামে লিখেছেন, “ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের হাতে এখনও অনেক কৌশল রয়েছে। তারা নাজুক ও সংঘাতময় সীমান্ত এলাকা থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষমতা সংহত করার মতো কৌশলও নিতে পারে।”
অ্যাডাম সিম্পসন আরও লিখেছেন, “অন্যদিকে যুদ্ধপরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার কেমন হবে তা নিয়ে বিদ্রোহীদের মধ্যে এখনো মতবিরোধ রয়েছে। জাতীয় ঐক্যের সরকার ও পিডিএফ মিয়ানমারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি জোর দিচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের ফেডারেল গণতান্ত্রিক সনদ বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠন জাতীয় ঐক্য সরকারে বামার জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য নিয়ে হতাশা জানিয়ে আসছে।”
জান্তা বাহিনীর মতো দেশটির গণতন্ত্রকামী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেও বামাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রধানদের বেশিরভাগও বামার। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ বলছে, জান্তার জন্য এটি অস্তিত্বের সংগ্রাম। জেনারেলদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তারা যদি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকে এবং আরও নির্মম হয় তবে তারা দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারে। অবশ্য বিদ্রোহীরাও পুরোপুরি সামরিক বিজয় চাইছে।