বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমার অংশে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ছন্দপতন ঘটিয়েছে বলে মনে করেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।
একই কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিকরা।
দিনভর বিরতির পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ আসতে থাকে। শব্দের তীব্রতায় কেঁপে কেঁপে ওঠে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তমব্রু সীমান্তবর্তী এলাকা। উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকায় থেকেও গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়।
নতুন এই সংঘাতে দেশে থাকা আত্মীয় স্বজনের জন্য দুশ্চিন্তা তো করছেনই, সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়েও শঙ্কায় পড়েছেন আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবাইর বলেন, “মিয়ানমার একবার গণহত্যা চালিয়ে আমাদের দেশ ছাড়া করেছে। তখন বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। মিয়ানমার আমাদের নিতে না চাইলেও বাংলাদেশ চীনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের দেশে ফেরাতে কাজ করছে। মিয়ানমার বলেছে আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু আরকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সরকারের লড়াই প্রত্যাবাসনের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।”
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমানও জানালেন, রাখাইনে চলমান সংঘাতে থমকে দাঁড়িয়েছে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার ছন্দপতন ঘটেছে।
তিনি বলেন, “সংঘাত হয়ত দীর্ঘমেয়াদী হবে না। আশা করি, পরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর জন্য সর্তক থাকতে হবে। যেন কোনোভাবেই নতুন অনুপ্রবেশ না হয়।”
আশঙ্কা বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুছ।
তিনি জানান, মিয়ানমারের মংডু ও আকিয়ার শহরের আশপাশের গ্রামগুলোয় এখনও চার-পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সেখানে জান্তা বাহিনী বোমা বর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করেছে। এতে অনেকেই হতাহত হয়েছে বলেও শোনা গেছে। অনেক রোহিঙ্গা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে বলেও খবর এসেছে।
ক্যাম্প-১ ইস্টের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “আমরা কীভাবে মিয়ানমারে যাব, তার কোনও রাস্তা পাচ্ছি না। এক মুহূর্তও ক্যাম্পে থাকার ইচ্ছা নেই, সম্ভব হলে এখনই চলে যেতে চাই। এটা আমাদের দেশ নয়, কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিও যাওয়ার উপযুক্ত নয়।”
ফের গোলাগুলি
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকেই মূলত নতুন করে গোলাগুলির শব্দ শুরু হয় বলে জানান ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ।
তিনি বলেন, সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমধুম সীমান্তের কাছে কোনও ধরনের গুলি বা মর্টাল শেল নিক্ষেপের শব্দ পাওয়া যায়নি। সীমান্তের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে আবারও থেমে থেমে আসতে থাকে গুলির আওয়াজ। শব্দ শুনে ধারণা করা হচ্ছে, সীমান্ত থেকে ২-৩ কিলোমিটার ভেতরে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে বুধবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়েছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, “সীমান্তের মূল দায়িত্ব বিজিবির। তবে বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় পুলিশের টহলও বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ানো হয়েছে, পুলিশ সতর্ক রয়েছে। কোনোভাবেই কেউ যেন মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”
বান্দরবানের সীমান্তের মতো একই অবস্থা টেকনাফ সীমান্তেরও। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর দূর থেকে গোলাগুলি শব্দ আসতে থাকে বলে জানান পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারি।
অন্যদিকে, গতরাতের পর সীমান্তের ওপার থেকে কোনও গোলাগুলির শব্দ না পাওয়ায় মঙ্গলবার ঘুমধুম সীমান্তবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান স্বাভাবিক রাখা হয়।
বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ফরিদুল আলম হোসাইনী ও বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানান, সীমান্ত এলাকার পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা এবং একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেবল সোমবারই বন্ধ রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার সেগুলোয় স্বাভাবিক নিয়মে ক্লাস হয়েছে।
তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, সীমান্তের পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।