বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করায় জেনারেলদের মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সম্প্রতি তিনজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া অপর তিনজন জেনারেলকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাজা পাওয়া এই জেনারেলরা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশের লাউক্কাই জেলায় জাতিগত বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
গত ৪ জানুয়ারি চীন সীমান্তের কোকাং-এ থ্রি ব্রাদারহুড জোটের একটি গ্রুপ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) কাছে ২২০ জনেরও বেশি সেনা কর্মকর্তাসহ প্রায় ২৪০০ জান্তা সেনা আত্মসমর্পণ করে। এমএনডিএএ তাদের জান্তা সরকারের কাছে ফেরত পাঠায়।
ফিরে গেলে জান্তা সরকার তিন জেনারেলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— লাউক্কাই সদর দপ্তরের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো কিয়াও থু, কোকাং স্ব-শাসিত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুন তুন মিন্ট ও ৫৫ ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাও মিও উইন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের ইয়াঙ্গুনের ইনসেইন কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরা হলেন— ১৪, ১৬ ও ১২তম অপারেশন সেন্টারের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আয়ে মিন উ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থ জিন উ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং জ লিন।
এই ছয় জেনারেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় নিজেদের অবস্থান ‘লজ্জাজনকভাবে ত্যাগ করার’ অভিযোগ এনে সামরিক আইনে সাজা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর লাউক্কাই জেলার নিয়ন্ত্রণ হারানো ছিল মিয়ানমারের জান্তার জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয়।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন কাউং থু উইন দ্য ইরাবতীকে বলেন, “জান্তার বাহিনী সাধারণত আত্মসমর্পণ করা সেনাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়।” কাউং থু উইন ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পরে সেনাবাহিনী ছেড়ে বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দেন।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, “যেসব জেনারেল সেনাঘাঁটি বা বড় কোনও কমান্ড হেডকোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন, জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং তাদের প্রতি কোনও করুণা দেখাবেন না। যুদ্ধরত অন্য কমান্ডাররা যাতে আত্মসমর্পণ না করে সেজন্যই এই কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।”
লাউক্কাই জেলায় পরাজয়ের পর মিন অং হ্লাইংয়ের সমর্থকরা তাকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছিল। জান্তা সরকারের অনেক সমর্থক মিন অং হ্লাইংকে অযোগ্য, স্বার্থপর ও মেরুদণ্ডহীন বলেও দোষারোপ করেছেন।
তাদের অভিযোগ, জেনারেল মিন অং হ্লাইং এক সময় অদম্য বলে বিবেচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অসহনীয় লজ্জা ও হতাশায় ডুবিয়েছেন।
থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অপর দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হলো, আরাকান আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। গত বছরের ২৭ অক্টোবর চীন সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শান প্রদেশে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যৌথ অপারেশন ১০২৭ শুরু করে। এতে নাটকীয়ভাবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়।
থ্রি বাদ্রারহুড অ্যালায়েন্স শান প্রদেশজুড়ে বেশ কয়েকটি সেনা সদর দপ্তর, প্রায় ১৭টি শহর ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটসহ ৫০০ টিরও বেশি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য জাতিগত বিদ্রোহী, মিলিশিয়া গোষ্ঠী ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে। ফলে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনা শাসকরা দেশজুড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে।
১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সেনা শাসকদের আর কখনও এমন নাজুক অবস্থায় পড়তে দেখা যায়নি। গত বছরের অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হামলার মুখে পতনের শঙ্কায় রয়েছে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সরকার। একের পর এক শহর ও অঞ্চলের দখল নিচ্ছে বিদ্রোহীদের জোট। জান্তার বাহিনীতেও বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। সংখ্যালঘু জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংখ্যাগুরু বামারদের জোট গড়ে উঠায় দেশটিতে সামরিক শাসনের অবসান ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।