সেনাশাসকের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লড়াই তীব্র রূপ নিয়েছে। তাতে বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।
গত কয়েকদিন ধরে ওপার থেকে একের পর এক গোলা এসে পড়ছে বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্তের ভেতরে। তাতে দুজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। পরিস্থিতি এমন যে সীমান্তের কয়েকশ পরিবারকে বাড়ি থেকে সরিয়ে আনতে হচ্ছে।
ওপারে সংঘাতে আহত হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের আড়াই শতাধিক নাগরিক। তাদের মধ্যে শতাধিক সীমান্ত রক্ষীসহ দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যও রয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এই পরিস্থিতির সমাধানে জাতিসংঘের দ্বারস্ত হওয়ার কথাও বলেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা।
বিশাল এই শরণার্থীর ভার বহন করার মধ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সচেষ্ট থাকার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী- বিজিবি।
৫ বাংলাদেশি আহত
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন থেকে শুরু করে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় থেমে থেমেই শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি, মর্টারের গোলা প্রায়ই এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসত ঘরে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের ২টি বসত ঘরে মর্টার শেল এবং ৫টি ঘরে গুলি এসে আঘাত হানে।
মঙ্গলবার সারাদিনে মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে আহত হয়েছেন ৫ বাংলাদেশি। এর মধ্যে ঘুমধুম সীমান্তে একজন, উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তের ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পালংখালী ইউনিয়নের নলবনিয়া এলাকার আয়ুবুল ইসলাম, রহমতেরবিল এলাকার আনোয়ার হোসেন, পুটিবনিয়া এলাকার মোবারক হোসেন ও মো. কালু আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
এর আগে তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহাড় পাড়া থেকে আশ্রয়কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় ওপার থেকে আসা গুলিতে আহত হন মো. সৈয়দ আলম নামের একজন।
সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসা বুলেট ও বোমার অংশে তাৎক্ষণিকভাবে হাত না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অবিস্ফোরিত বুলেট ও বোমা বিস্ফোরণ হয়ে হতাহত হতে পারেন। তাই সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সতর্ক থাকতে হবে।
তার সঙ্গে থাকা বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন ও বিজিবির সঙ্গে পুলিশও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
ঘর ছাড়তে হচ্ছে সীমান্তবাসীদের
সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার বান্দরবানের ঘুমধুম এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা ২৪০টি পরিবারের মধ্যে ১৮০টি নিরাপদ আশ্রয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৫০ পরিবার নিজ উদ্যোগে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন আর জলপাইতলী এলাকা থেকে ৩০টি পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের দ্রুত সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজারে ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
পালিয়ে এসেছেন ২৬৪ জন
সংঘাতের জেরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজছেন অনেকে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পালিয়ে আসা মোট ২৬৪ জন বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন। বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৬৪ জনের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), সেনাসদস্যসহ রয়েছে।
পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের মধ্যে আহত ৯ জনকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকাকে ফেরত
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলার দমদমিয়া নাফনদী জিরো লাইন দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় একটি নৌকাকে ঠেকিয়েছেন বিজিবির সদস্যরা। ওই নৌকায় ৬৫ জন রোহিঙ্গা ছিলেন। টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো মহিউদ্দিন আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মিয়ানমার দূতকে তলব
সীমানায় উত্তেজনার বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের দূত অং কিয়াও মোয়েকে তলব করা হয় মঙ্গলবার। এসময় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে সীমান্তে যা হচ্ছে তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ মন্তব্য করে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “তাদের (মিয়ানমার) ৩০টির মতো মর্টার শেল আমাদের দেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে এবং দুজন নিহত হয়েছেন। আজ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।”
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের উদ্বেগ ও প্রতিবাদ তার সরকারের কাছে জানাবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমার প্রসঙ্গে সৃষ্ট উদ্বেগের কথা জাতিসংঘকে জানাবে বাংলাদেশ।
“জাতিসংঘ আছে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আমরা করব। সবারই একটা ফোরাম আছে, সেই ফোরামে আমাদের উদ্বেগের কথা জানাব। জাতিসংঘেরও একটা ভূমিকা আছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করব।”
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে মর্টারের গোলা উড়ে আসার ঘটনাকে ‘দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জলাঞ্জলি’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহল কবির রিজভী বলেছেন, দেশের নাগরিকদের রক্ষায় সরকার কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
জান্তার ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে
মিয়ানমারের বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার আরও দুটি ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ম্রাউক উ ও ক্যাউকতাও শহরে জান্তার দুটি সদরদপ্তর এখন আরাকান আর্মির দখলে।
রাখাইন রাজ্যভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা হলো আরাকান আর্মি। এদের কার্যক্রম মূলত রাখাইন ও চিন রাজ্যকেন্দ্রিক।
বাহিনীটির দাবি, গত ১৩ নভেম্বর থেকে উত্তর রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে তারা। এই সময়ের মধ্যে জান্তা বাহিনীর ১৭০টি স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রাখাইন রাজ্যের কাছের পাউকতাও শহরও রয়েছে।