Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

মিয়ানমারের মার্সিডিজ ভিক্ষু ও সবুজ উর্দিধারীরা

Untitled design (3)
[publishpress_authors_box]

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বা মান্দালয় শহরের রাস্তায় মার্সিডিজ বা বেন্টলি গাড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য এখন বেশ স্বাভাবিক একটি বিষয়।

এমন দৃশ্য দেখে কে বলবে যে মিয়ানমারের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাজুড়ে গৃহযুদ্ধ চলছে। জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।

অথচ মিয়ানমার ও দেশটির জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুদের অবস্থা কিন্তু এমন ছিল না। দেশটি ছিল একটা সময় বিশ্বের শীর্ষ উদার দেশগুলোর অন্যতম। মিয়ানমারকে বিভিন্ন দেশ ঔদার্যের জন্য অনুকরণীয় মনে করতো।

আর দেশটির ভিক্ষুরা তাদের সহিষ্ণু মতবাদ ও জীবনাদর্শনের জন্য ছিল বহু মানুষের আদর্শ। হাজার হাজার তরুণ এসব ভিক্ষুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানবিক জীবন গড়ে তুলেছিল।

মাত্র দুই দশকের মধ্যে এসব কেবলই স্মৃতি হয়ে গেছে। মিয়ানমারে আজ সর্বত্র আতঙ্ক। ভিক্ষুদের একাংশ রাজনৈতিকভাবে জান্তার পক্ষ নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। আবার আরেক অংশ সামরিক শাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

এসবই ২০২১ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারের চিত্র।

মিয়ানমারের শান রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য।

অভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসনকে সমর্থনকারী ভিক্ষু অধ্যক্ষদের ক্ষমতার পাশাপাশি বেড়েছে অর্থবিত্ত। জেনারেলরা নিয়মিতই এসব অধ্যক্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এমনকি ভিক্ষুদের দামি ও আকর্ষণীয় পুরষ্কারও দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত।

অবশ্য ক্রমেই এসব সুযোগসন্ধানী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জনগণের সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে। ‘সেলিব্রেটি ভিক্ষু’ ও জান্তার ‘অন্তরঙ্গ ভিক্ষু’ জাতীয় বিভিন্ন তকমা জুটছে তাদের। অনেক ভিক্ষুকে বয়কটও করছেন মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ।

এসব ভিক্ষুরা প্রকাশ্যে সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছে এবং দেশজুড়ে হওয়া সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরব থাকছে। এই সেলিব্রেটি ভিক্ষুদের চোখে চোখে রাখছেন দেশটির নিপীড়িত জনগণ, অধিকারকর্মী ও বিরোধী রাজনীতিকরা।

ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য বিখ্যাত। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে তারাই প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিল। পরবর্তীকালে বর্তমান সামরিক জান্তার পূর্ববর্তী শাসনগুলোর বিরুদ্ধেও তাদের প্রতিবাদ জারি ছিল।

আজকের দিনে অনেক ভিক্ষু, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীরা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, অস্বচ্ছ সম্পদ ও লাভজনক ব্যবসা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।

এটি একটি সুবিধাজনক মেলবন্ধন। সামরিক নেতারা তাদের সহযোগী ভিক্ষুদের সম্পদ ও সুরক্ষা দেয়। এর বিনিময়ে তারা বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বৈধতা অর্জন করে মিয়ানমারে ইসলামের প্রচার থেকে বৌদ্ধধর্মকে রক্ষার দাবি করে তারা।

মিন অং হ্লাইং ও তার স্ত্রী কু কু হ্লা হীরকখচিত মুকুট দান করছেন জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু সিতাগু সায়াদাউকে।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের অনেক আগে থেকেই দেশটির রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়বাদী ভিক্ষুদের একটি গোষ্ঠী সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে।

ধর্মীয় ভাবাবেগকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে জান্তা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনের ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন’র সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছে। সংগঠনটিকে স্থানীয়ভাবে ‘মা বা থা’ নামে ডাকা হয়।

২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত মা বা থা সংগঠনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে দেওয়া ও ধর্মীয় সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি জেনারেল থেন সেইনের ২০১১-২০১৬ সালের শাসনামলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক নেতারা মা বা থাকে সমর্থন করেছিল।

২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক বাহিনীও একই খেলা অব্যাহত রেখেছে। তারাও ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পর থেকে দুজন বিশিষ্ট ভিক্ষু জান্তার প্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা হলেন- সিতাগু সায়াদাউ আশিন নানিসারা ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা।

৮৭ বছর বয়সী সিতাগু সায়াদাউ মিয়ানমারের নয়টি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি শ্বে ক্যিন সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের আগে তিনি মিয়ানমারের সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রভাবশালী ভিক্ষুদের একজন ছিলেন। দেশে-বিদেশে তার ভক্তের সংখ্যা কয়েক লাখ।

আর ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা গ্রীষ্মের ছুটিতে তরুণদের জন্য কর্মসূচি তৈরি করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শত শত তরুণকে আকর্ষণ করেছিল ওই কর্মসূচি। তিনি ইয়াঙ্গুনে আন্তর্জাতিক থেরবাদ বৌদ্ধ মিশনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। দেশব্যাপী তার অনেক অনুসারীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও অনুসারীর সংখ্যা কম নয়।

মস্কোতে প্যাগোডা উদ্বোধন করছেন জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু অশিন চেকিন্দা।

উভয় ভিক্ষুই ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে অভ্যুত্থানকারী মিন অং হ্লাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছেন। তারা অভ্যুত্থানের কয়েক মাস আগেই সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

জান্তার অত্যাচার নিয়ে মুখ বন্ধ রাখার জন্য উভয়েই আজ সমালোচনার শিকার।

২০২২ সালে সিতাগু সায়াদাউ অভ্যুত্থানকারী মিন অং হ্লাইংকে ‘রাজা’ হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। এমনকি এই জেনারেলকে মিয়ানমারের সর্বোচ্চ বৌদ্ধ উপাধিও দেওয়া হয় তখন।

মিন অং হ্লাইংয়ের আরেক সমর্থক হলেন পূর্ব শান রাজ্যের ইউ কোভিদা। তিনি ভাসিপাকে সায়াদা নামেও পরিচিত। মিয়ানমারে তিনি তার জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পূর্বাভাস ও নীরবতার জন্য বিখ্যাত।

অভিযোগ আছে, ভাসিপা সায়াদাই অভ্যুত্থানের পর প্রতিবাদকারীদের দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে উচ্চপদস্থ এক জেনারেলকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

নেপিদোতে এই ভিক্ষুরা জান্তা ও জান্তার সঙ্গে যুক্ত দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে অনুদান, বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ ও উচু পদবি লাভ করেছেন।

সিতাগু সায়াদাউ ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা ২০২২ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে রাশিয়া গিয়েছিলেন মস্কোতে একটি প্যাগোডার উদ্বোধন করতে।

২০১৩ ও ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য সংস্থার প্রকাশিত বিশ্বব্যাপী উদারতার সূচকে মিয়ানমারের অবস্থান ছিল শীর্ষস্থানের কাছাকাছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির বদান্যতা অন্য দেশের জন্য অনুপ্রেরণার হয়ে দাড়িয়েছিল।

ইয়াঙ্গুনে নিজের বাড়ির সামনে মার্সিডিজ গাড়িতে উঠছেন সিতাগু সায়াদাউ।

এটি আংশিকভাবে মিয়ানমারে থেরাবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাবের প্রতিফলন। এর অনেক অনুসারী বিশ্বাস করেন, এই জীবনে আপনি যা করবেন তার প্রভাব পরবর্তী জীবনে পড়বে। সেই বিশ্বাসের প্রচারে ভিক্ষুরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রায়ই ‘সংসার’ শব্দটি বলতে শোনা যায়। এর অর্থ ‘চক্রাকারে ঘোরা’। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে যে, কর্মফলের চক্রে জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মাধ্যমে দুঃখ ভোগ হয়। ভিক্ষুরা সাধারণত দানের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে তাদের বক্তব্য শেষ করে।

আর এই দানের সূত্র ধরেই ধনী থেকে অতি ধনী হয়ে উঠেছেন মিয়ানমারের অনেক ভিক্ষু। সিতাগু সায়াদাউ তেমনি একজন। তার বিশাল গাড়িবহরে রোলস রয়েস, মার্সিডিজ, লিঙ্কন, বেন্টলির মতো দামি গাড়ি রয়েছে। শুধু কি তাই, বছরে তার কয়েকশ কোটি টাকার বেশি উপার্জন দান ও ব্যবসা থেকে।

মিয়ানমারের ভিক্ষুদের এমন অবস্থা কিন্তু অতীতে ছিল না। উপনিবেশিক আমল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশটির রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রে ছিলেন তারা।

সময় বদলেছে। মিয়ানমারের ভিক্ষুরা আজ বিভক্ত। সামরিক শাসনবিরোধী ভিক্ষুদের দেওয়া হয় সাজা। আর যারা শাসনের পক্ষে তাদের দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা। জেনারেলদের বাসভবনে প্রায়ই তাদের ভোজসভায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

স্বর্গ ও মর্ত্যের হিসেব কষা ভিক্ষুরা আজ অর্থ উপার্জনে অসাধারণভাবে সফল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত