শোভাযাত্রার দুইদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ উপলক্ষ্যে বানানো আলোচিত মোটিফ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ আগুনে পুড়ে গেছে। শনিবার ভোররাতের এ আগুনকে রহস্যজনক বলছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, কেউ ইচ্ছে করেই সেখানে আগুন দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। চারুকলা অনুষদ জানিয়েছে, আগুনের ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অভিযোগ করে বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দোসররা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব’ পুড়িয়ে দিয়েছে।
এ ঘটনায় একজনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আগুন দেওয়ার সময় মুখে মাস্ক থাকায় তার পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, শনিবার ভোর ৫টা ৪ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ৫টা ২২ মিনিটে আগুন নেভায়।
তিন যুগ ধরে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির বর্ষবরণের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর তার নাম গেল বদলে। এবার পহেলা বৈশাখে যে শোভাযাত্রা বের হবে, তার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ঠিক হওয়ার কথা জানানো হয় শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে।
বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফটির উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। এখন এই এতবড় মোটিফ পুনরায় আবারও বানানো যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম।
মোটিফটি মূলত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসাবে বানানো হয়েছিলো বলে অনেকে মনে করেন। এ নিয়ে গত কিছুদিন ধরে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনাও চলছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানকে সামনে রেখে এবারের নবর্ষের প্রতিপাদ্য হলো ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এটিকে সামনে রেখেই ওই মোটিফ বানানো হয়েছিলো।
প্রক্টর কী বলছেন
আগুনের ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে সে প্রশ্নে শনিবার সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশ একটু অন্য পাশে ছিল। প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের দুইজন ৪টা ৫০-এর দিকে নামাজে যায়। যাওয়া আগে পুলিশকে বলে গেছে যে একটু খেয়াল রাখেন। তখনই হয়তো এ কাজ করা হয়েছে।”
‘শান্তির পায়রা’ মোটিফের একাংশেও আগুন লাগে বলেও জানান প্রক্টর।
ফায়ার সার্ভিস
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা রুহুল আমিন মোল্লা বলেন, নববর্ষের শোভাযাত্রা উদ্যাপনের জন্য অনেকগুলো মোটিফ সেখানে রয়েছে। এর মধ্যে কেন শুধু দুটি মোটিফে আগুন লেগেছে, সেটি রহস্যজনক।
হাসিনার দোসররা ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে : ফারুকী
আগুনের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ বিষয়ে নিজের ফেরিফায়েড ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করেন তিনি।
এতে তিনি বলেন, “হাসিনার দোসররা গতকাল ভোর রাতে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে- সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।
“এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদেরকে আইনের আওতায় আনবো তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়।
“কালকে রাতের ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটা চায় না। আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইন্ড এবং আরও বেশি সংখ্যায় অংশ নিব।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টা ফারুকী আরও লেখেন, “গত কিছুদিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সবরকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরও অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠল। জুলাই চলমান।”
কী বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা
শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
এসময় তিনি বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে দেখে যেটা মনে হচ্ছে এটা এক্সিডেন্টাল না, কেউ ইনটেনশনালি এটা করছে। এটুকু আমরা নিশ্চিত। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। ভোর ৫টা ৬ এ যখন আমি কন্ট্রোলে ফোন করি, আমাকে জানাইছে ৫ টা ৫ এ ঘটনাটা ঘটছে।
“এখানে চতুর্পাশে অনেক ক্যামেরা আছে। আমরা ডিজিটাল রেকর্ডগুলো নেব, ফরেনসিক করব। ডিটেকশন করে ফেলব ইনশাল্লাহ। এ পর্যায়ে বলার স্কোপ আসে নাই যে, পার্টিকুলারলি কারা করছে। এটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। এটা ইনভেস্টিগেশনে বের হবে।”
তিনি আরও বলেন, “তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। এখানে দুইটা মোটিফ পোড়ানো হইছে। বিগত সরকার প্রধান ছিল, তার একটা পোট্রেইট করা হইছে। ওইটা পোড়াইতে গিয়া সম্ভবতো কবুতরের আংশিক অংশ পোড়ানো হইছে। তাইলে ওই জিনিসটা যারা লাইক করে না, তারা এই কাজটা করবে। এটা একটা অনুমান নির্ভর কথা।”
আগুনের ঘটনার তদন্তে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, শোভাযাত্রার জন্য বানানো দুটি মোটিফে আগুন দেওয়ার ঘটনায় একজনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আগুন দেওয়ার সময় তার মুখে মাস্ক থাকায় তার পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এবারের শোভাযাত্রার আয়োজনে বানানো অন্য বড় মোটিফগুলোর মাঝে রয়েছে— কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, শান্তির পায়রা, পালকি, তরমুজ, গণঅভ্যুত্থানে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল।
এছাড়া অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে— ১০টি সুলতানি ও মোগল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস।