ডিজিটাল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ এর বিগত দিনের লেনদেনে কোনও অনিয়ম বা জালিয়াতি ঘটেছিল কি না- তা খতিয়ে দেখতে ‘ফরেনসিক অডিট’ করা হবে। রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে পরিচালনা পর্ষদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে এ সভা হয়। সভায় এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদে ফরেনসিক অডিটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে বেক্সিমকো গ্রুপে রিসিভার নিয়োগ, ব্যাংকিং খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স অনুমোদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অডিট কমিটি পুনর্গঠনসহ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মুখপাত্র বলেন, পর্ষদ সভার আলোচ্যসূচির এক নম্বর ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট কমিটি পুনর্গঠন। এখানে নজরুল হুদার পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল আহমেদ তিতুমীরকে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে শুরু হয় নগদের কার্যক্রম। প্রকাশ্যে নগদকে ডাক বিভাগের সেবা বলা হলেও বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি বিভাগটির কোনও মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে কার্যক্রমে আসা নগদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও ছিল সমালোচনা। বিশেষ করে, গ্রাহক ধরতে প্রতিষ্ঠানটি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছিল, তাও প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। এছাড়া সরকারি ভাতা বিতরণের জন্য নগদ অগ্রাধিকার পেয়ে আসছিল। ফলে সরকারি ভাতা ভোগীদের বাধ্য হয়ে নগদের গ্রাহক হতে হয়।
নগদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইচ্ছামতো ইলেকট্রনিক মানি বাজারে ছেড়েছে বলেও অভিযোগ ছিল। শেল কোম্পানির আড়ালে বিদেশি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের নামে বিনিয়োগ দেখানোরও অভিযোগ ছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থাই নগদের কোনও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদের এমএফএস লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দেওয়ায় ডাক বিভাগকে মালিকায় যুক্ত করতে বাধ্য হয়।
নগদের মালিকানার সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী রেজওয়ানা নূর, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২১ আগস্ট নগদকে চালানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন ২২ আগস্ট প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ছয় জন কর্মকর্তাকে ‘সহায়ক কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া নগদের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান করা হয়ে বিআইডিএসর সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদকে।
নগদের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মারুফুল ইসলাম দায়িত্বে নেই। তারা প্রত্যেকেই নগদের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত।
নগদ-এ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত প্রশাসক বদিউজ্জামান দিদার অনিয়ম খুঁজে বের করতে ফরেনসিক অডিট করার জন্য ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডাক অধিদপ্তরের আলোচনা হয়। দুই পক্ষ একমত হওয়ায় ফরেনসিক অডিট করার সিদ্ধান্ত হয়, যা এবার পর্ষদ সভায় অনুমোদন হলো।
এখন নিয়ম অনুযায়ী ডাক অধিদপ্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত কোনও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেবে, যারা নগদের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সব কাজের ফরেনসিক অডিট করবে।
ফরেনসিক অডিট হলো কোনও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য খতিয়ে দেখা। অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালিত এই নিরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে জালিয়াতি বা অনিয়ম খুঁজে বের করা সম্ভব। সাধারণত এ নিরীক্ষায় কোনও অনিয়ম ধরা পড়লে তা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যবহার করা হয়।