যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির পরাজয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই দায়ী করেছেন দেশটির পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।
তিনি বলেন, জো বাইডেন যদি আরও আগেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতেন তাহলে মঙ্গলবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা আরও ভালো ফল করতে পারত।
বিবিসি জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের অন্যতম শক্তিশালী রাজনীতিবিদ পেলোসি শনিবার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন।
তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট যদি আরও আগেই নির্বাচনী দৌড় থেকে বেরিরে যেতেন, তাহলে প্রতিযোগিতায় অন্য প্রার্থীরাও থাকতে পারত।”
গত মঙ্গলবারের নির্বাচনে হোয়াইট হাউস এবং পার্লামেন্টের (কংগ্রেস) উভয় কক্ষের (সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ) নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর থেকেই ডেমোক্রেটরা বাইডেনকে দায়ী করতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় পেলোসিও বাইডেনের দিকেই আঙ্গুল তুললেন।
পেলোসি ক্যালিফোর্নিয়ার একজন কংগ্রেসওম্যান, যিনি মঙ্গলবার তার ২০তম মেয়াদে পুনরায় প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
জুনের শেষদিকে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের প্রথম বিতর্কে ধরাশায়ী হওয়ার পর বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া ডেমোক্রেটদের মধ্যে পেলোসি ছিলেন প্রধানতম একজন। কিন্তু বাইডেন কয়েক সপ্তাহ ধরে গড়িমসি করে অবশেষে জুলাইয়ের শেষে গিয়ে সরে দাঁড়ান।
বাইডেন সরে দাঁড়ানোর সময় দ্রুত ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে তার জায়গা নেওয়ার জন্য সমর্থন করেন। আর কমলা হ্যারিস মঙ্গলবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ক্ষতবিক্ষত পরাজয় বরণ করেন।
পেলোসি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “দলের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল, প্রেসিডেন্ট বাইডেন সরে দাঁড়ালে নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের জন্য একটি উন্মুক্ত প্রাইমারি হবে।
“উন্মুক্ত প্রাইমারিতে বেশ কয়েকজন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী প্রতিযোগিতা করতেন এবং তাদের মধ্য থেকেই একজন দলের সদস্যদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হতেন।”
পেলোসি বলেন, “কমলা হ্যারিস প্রাইমারিতে ভাল করতেন এবং এটি তাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে আরও শক্তিশালী করে তুলত। কিন্তু আমরা তা জানি না। এটি ঘটেনি। আমরা যা ঘটেছে তা নিয়েই বেঁচে আছি।
“যেহেতু প্রেসিডেন্ট বাইডেন কমলা হ্যারিসকে অবিলম্বে সমর্থন করেছিলেন, এটি সত্যিই সেই সময়ে দলের প্রাইমারির নির্বাচন হওয়া প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল। যদি তা আরও আগে হত তাহলে বিষয়টি অন্যরকম হত।”
রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যম দ্য পলিটিকোর সঙ্গে কথা বলার সময় কমলা হ্যারিসের সহকারীরাও বাইডেনের ঘাড়েই দোষ চাপান। তারও বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে হারার পর তার আরও আগেই মাথা নত করা উচিৎ ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলার একজন সহকারী মঙ্গলবার বলেন, “জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেটা মাথায় রেখেই, আমরা আমাদের পক্ষে সম্ভব সবচেয়ে ভালো প্রচারণা চালিয়েছি। জো বাইডেন আজ রাতে কমলা হ্যারিস এবং ডেমোক্র্যাটদের হেরে যাওয়ার একমাত্র কারণ।”
তবে বাইডেনের একজন প্রাক্তন সহযোগী আরেকটি রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যম অ্যাক্সিওসকে বলেন, “কমলা হ্যারিস এখন অজুহাত তৈরি করছেন।”
রাগান্বিত হয়ে তার প্রশ্ন, “১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেও কেন কমলা হ্যারিস জিতলেন না?”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাইডেনের সাবেক আরেক সহযোগী এই দ্য পলিটিকোকে বলেছিলেন, “সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টারাও ডেমোক্রেটদের পরাজয়ের জন্য দায়ী। কারণ তারা জো বাইডেনকে সরানোর জন্য ডেমোক্রেটদের মধ্যে গৃহবিবাদকে প্রকাশ্যে উৎসাহিত করেছিলেন, এমনকি কমলা হ্যারিসকেও তারা মনোনীত করতে চাননি।”
পেনসিলভ্যানিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর জন ফেটারম্যানও বাইডেনকে সরাতে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের উপরই নির্বাচনে পরাজয়ের দায় চাপিয়েছেন।
রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যম সেমাফোরকে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “যারা বাইডেনকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তারপরে আপনারা যে নির্বাচন চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন, এখন এই ফলাফল ও পতন আপনাদেরই।”
নিউইয়র্কের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান টম সুওজি বলেছেন, নির্বাচনের পরাজয় আংশিকভাবে পার্টির “রাজনৈতিকভাবে সঠিক হওয়ার” দিকে বেশি মনোনিবেশ করার কারণে হয়েছে।
তিনি বলেন, “কলেজ ক্যাম্পাসে নৈরাজ্য, পুলিশের তহবিল কমাতে ডেমোক্রেটদের দাবি, মেয়েদের খেলাধুলায় ছেলেদের অংশগ্রহণ এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতি বিষয়ে রিপাবলিকানদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে দল।”
আরেক নিউইয়র্ক ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান রিচি টরেস এক্সে এক পোস্টে এবারের নির্বাচনে হারের জন্য “অতি বামদের” দোষারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অতি বামদের ‘পুলিশের তহবিল কমানোর দাবি’ বা ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ স্লোগান এবং ল্যাটিংক্স এর মতো অযৌক্তিক আন্দোলন “ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে ঐতিহাসিক সংখ্যক ল্যাটিনো, কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় এবং ইহুদিদের ভোট সরিয়ে দেয়।”
স্বাধীন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এক দীর্ঘ বিবৃতিতে ডেমোক্রেট পার্টিকে শ্রমজীবী মানুষদের ত্যাগ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, বার্নি ২০১৬ এবং ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “শ্রমিক শ্রেণীর ভোটারদের ডেমোক্রেটিক পার্টির দিক থেকে মুখে ঘুরিয়ে নেওয়া বিস্ময়কর নয়। প্রথমে, শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণী এবং এখন লাতিন ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরাও দলটিকে ছেড়ে গেল।
“ডেমোক্রেট নেতৃত্ব স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। অন্যদিকে, আমেরিকান জনগণ ক্ষুব্ধ এবং পরিবর্তন চায়। এবং তারা সঠিক।”
তিনি আরও বলেন, ডেমোক্র্যাটরা সম্ভবত এই নির্বাচনের ফলাফল থেকেও শিক্ষা নেবে না।
তবে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান জেইম হ্যারিসন এক্স-এ পোস্ট দিয়ে স্যান্ডার্সের অভিযোগকে ‘পুরোপুরি ভুয়া’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, “জো বাইডেন আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে শ্রমিক-বান্ধব প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যিনি ইউনিয়ন পেনশন বাঁচিয়েছিলেন, লাখ লাখ ভাল বেতনের চাকরি তৈরি করেছিলেন এবং এমনকি একটি পিকেট লাইনেও মিছিল করেছিলেন।”
হ্যারিসন কমলা হ্যারিসের পক্ষও সমর্থন করে বলেন, “কমলা এমন সব নীতির প্রস্তাব করেছিলেন যা মূলত জীবনযাত্রার গুনগত মানকেই পুরোপুরি বদলে দিত এবং এই দেশের শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে জাতিগত সম্পদের ব্যবধান কমাতো।”