Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ডাকাত আতঙ্কে ছিল বাঘারী, মাইকে ঘোষণায় জড়ো হয় সবাই

নারায়ণগঞ্জের সোনারাগাঁ উপজেলার বাঘারী গ্রামে রবিবার রাতে ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
নারায়ণগঞ্জের সোনারাগাঁ উপজেলার বাঘারী গ্রামে রবিবার রাতে ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জ

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জ

ডাকাত আতঙ্ক ছিল কয়েকদিন ধরেই; ততে গ্রামবাসীও ছিল প্রস্তুত হয়ে। এরই মধ্যে রবিবার মধ্যরাতে বাঘারী গ্রামের বিলপাড়ে দেখা যায় অচেনা কয়েকজনকে। তাদের দেখেই ‘ডাকাত’ আসার ঘোষণা দেওয়া হয় মসজিদের মাইকে। এরপর চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পিটিয়ে মারা হয় চারজনকে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারাগাঁ উপজেলার বাঘারী গ্রামে রবিবার রাতে ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যার পর পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

নিহতদের তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ঝাউকান্দী নিতাইটেক গ্রামের সামসুল হকের ছেলে আব্দুল রহিম (৪৮), জালাকান্দি গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে নবী হোসেন (৩৫) ও সোনারগাঁ উপজেলার মুছারচর গ্রামের আমানুল্লাহর ছেলে জাকির হোসেন (৪০)। আরেকজনের পরিচয় শনাক্তে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।

গণপিটুনিতে আহত হন আড়াইহাজারের জাঙ্গালিয়া গ্রামের নুরু মিয়ার ছেলে ৪৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী। তাকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্ত্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে।

রবিবার রাত ১টার দিকে বাঘারী গ্রামের বিলের পাড়ে সাত-আটজনের অচেনা একটি দলকে দেখে স্থানীয়রা প্রথমে অন্যদের খবর দেয়। পরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে গ্রামের মানুষ তাদের ঘিরে ফেলে।

স্থানীয়রা জানায়, তখন তাদের ধরে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে মারা যান তিনজন। অন্যরা বিলে ঝাঁপ দেন। পরে বিল থেকে উঠিয়ে আরও দুজনকে পেটানো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান একজন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রামবাসীর হাতে হাতে টেটা, বল্লম, দা, বাঁশ ও লাঠি। তারা ডাকাত সন্দেহে তাদেরকে বিল থেকে তুলে যার হাতে যা ছিল, তা দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর মাথায় লাথি মারতে থাকে।

খবর পেয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। পুলিশ আসার খবরে গ্রামবাসী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

সোমবার সকালে বাঘারী গ্রামে গেলে স্থানীয়দের কাছ থেকে গণপিটুনির শিকার মোহাম্মদ আলীর ‘ঘটনাস্থলে দেওয়া একটি জবানবন্দির ভিডিও’ পাওয়া পাওয়া যায়। এতে তাকে আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।  

ভিডিওতে মোহাম্মদ আলীকে বলতে শোনা যায়, রবিবার রাত ১০টার দিকে তারা তিনজন বন্দর উপজেলার মদনপুর নাজিম উদ্দীন ভূঁইয়া কলেজের সামনে দিয়ে বিলে আসেন। তাদের সাতজন বাঘরী বিলের বানিয়াবাড়ি এলাকার এক বাড়িতে ডাকাতির জন্য জড়ো হন। কিন্তু স্থানীয়দের চোখ এড়াতে পারেননি। বিলে জড়ো হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই মসজিদের মাইকের ঘোষণা শুনে গ্রামবাসী তাদের ধরে ফেলে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পিটুনির পর তারা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। রাত ৩টার দিকে বিলের দক্ষিণ পাশে একজনের মরদেহ পায় পুলিশ। আহত অবস্থায় দুইজনকে উদ্ধার করে পুলিশের ভ্যানে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। 

ঘটনাস্থল থেকে সোনারগাঁ থানার পুলিশ পরির্দশক মহসিন মিয়া জানান, রাতে একজনের মরদেহ পাওয়া যায়। আহত দুইজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও একজনের মৃত্যুর খবর আসে। সকালে আরও দুইজনের মরদেহ পাওয়া যায়। নিহতদের শরীরের বেশিরভাগ অংশেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় হাজার একরের এ বিলে এখন ইরি ধান রয়েছে। বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে বিলটি। এর উত্তরে কাঁচপুর, দক্ষিণ-পশ্চিমে বন্দরের মদনপুর এবং পূর্বে সাদিপুর ইউনিয়ন। এ তিন ইউনিয়নে ১৫টি গ্রাম রয়েছে। এ বিলের বিভিন্ন গ্রামে প্রায়ই ডাকাতি হয়।

রবিবার রাতে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে বাঘরী গ্রামের বাসিন্দা সামসুল আলম বলেন, “রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে গ্রামের মসজিদের মাইকে কেউ একজন বলতে থাকেন বিলে ডাকাত পড়েছে।

“এই খবর শুনে অন্যদের মতো আমিও বিলের কাছে যাই। দেখতে পাই পাঁচজন লোক বিলের পানিতে। গ্রামের মানুষ তাদের একে একে উপরে উঠিয়ে পেটাতে থাকে।” 

গ্রামের আরেক বাসিন্দা পোশাক কারখানার শ্রমিক রবিন চৌধুরী বলেন, “রাতে কারখানা থেকে বাড়িতে ফিরেই শুনি এলাকায় ডাকাতের বড় একটা দল এসেছে। তখন গ্রামের মানুষ যার ঘরে যা ছিল তাই নিয়ে ডাকাত দমনে বের হয়।”

গ্রামের অন্তত ছয়জন বাসিন্দা জানিয়েছেন, গত ১৫ মার্চ শুক্রবার রাতে বিলের পূর্বপাড়ে কুন্দেরপাড়া এলাকার প্রয়াত শামসুল হক মাস্টার ও ইসলাম মুন্সীর বাড়িতে ডাকাতি হয়। ইসলাম মুন্সীকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা আশপাশের সব গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে বাঘারী বিলের প্রায় সব গ্রামেই ডাকাত আতঙ্ক ছিল। থানায়ও অভিযোগ করা হয়।

সোনারগাঁ থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নিহতের মধ্যে জাকির হোসেন ২০২২ সালের ৩ মার্চ উপজেলার সাদীপুর গ্রামের নানাখী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে দুই সঙ্গীসহ পিটুনির শিকার হন। গত বছর মহজমপুর গ্রামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বাড়িতে ডাকাতি করার পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ডাকাতপ্রবণ এ বিলে ২০১৬ সালেও গ্রামবাসীর পিটুনিতে এক ডাকাত নিহত হয়েছিলেন।

গণপিটুনিতে নিহত চারজন ডাকাত দলের সদস্য বলে জানিয়েছেন সোনারগাঁ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন। তিনি আরও জানান, নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় মিলেছে। আরেকজনকে সনাক্ত করতে সিআইডি কাজ করছে।

জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত ১০টি ও মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি মামলা আছে। আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা আছে। নবী হোসেনের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে।  

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন বলেন, চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ আলীর জবানবন্দি ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে জাকির হোসেনের নেতৃত্বে রবিবার রাতে সাতজন ডাকাতি করতে ওই বিলে জড়ো হন। চারজন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। অন্যরা পালিয়েছেন।

ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের লোকজন পাওয়া গেলে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল।

তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। জাকিরের মরদেহ আছে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতাল মর্গে।

পুলিশ সুপার জানান, পুলিশ ঘটনার সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করছে। মামলার পর পরবর্তী আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ জানিয়েছে, নিহত তিনজনের কোনও স্বজন তাদের খোঁজে বা মরদেহ নিতে আসেনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত