Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

‘এবার পতাকা কিনার মানুষ পাইতেছি না’

ss-flag seller-121224 (3)
[publishpress_authors_box]

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ফুলকারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪৫)। গত ২২ বছর ধরেই তিনি জীবন চালান ঢাকায় পণ্য ফেরি করে।

বছরের অন্যান্য সময় নানা রকম পণ্য বিক্রি করলেও স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর বিজয় দিবসের আগের কয়েকটা দিন সারা শহরে হেঁটে হেঁটে জাতীয় পতাকা বিক্রি করেন মিজানুর। অন্যান্য বছর এ কাজে বেশ আয় করলেও এবার একেবারেই হতাশ তিনি।

মিজানুর রহমানের ভাষায়, “এবার পতাকা কিনার মানুষ পাইতেছি না। সারা দিন ঘুরেও নিজের খরচের টাকাই উঠতেছে না, বাড়িত কী পাঠামু!”

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটের সামনে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে পতাকা বিক্রি করছিলেন মিজানুর রহমান। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বিজয় দিবসের বাকি আর ৩/৪ দিন। আগের বছরও এই সময় প্রতিদিন ৩ হাজার টাকার বেশি পতাকা বিক্রি করছি। আজ সকাল ১০টায় বের হইছি, এখন বাজে রাত ৯টা। বিক্রি হইছে মাত্র ৯০০ টাকার। এই বিক্রিতে নিজের খাওয়ার খরচই ওঠে না।”

এখানকারই কাঁটাসুর এলাকার একটি মেসে থাকেন মিজানুর রহমান। বিক্রির জন্য পতাকা আনেন মিরপুর-১০ নাম্বারের একটি আড়ত থেকে। জাতীয় পতাকার পাশাপাশি লাল-সবুজ রঙের মাথার ও হাতের ব্যান্ড, কাগজের তৈরি খেলনাও বিক্রি করেন তিনি।

মিজানুর জানান, স্ট্যান্ডে লাগানোর জন্য তার কাছে থাকা সবচেয়ে বড় পতাকার দাম ৩০০ টাকা। আর সবচেয়ে ছোটটির দাম ৩০ টাকা। এছাড়া প্লাস্টিকের ছোট দণ্ডে লাগানো কাগজের পতাকা বিক্রি হয় ১০ টাকায়। আর লাল-সবুজ রঙের মাথা ও হাতের ব্যান্ডের দাম ১০ টাকা।

আড়ত থেকে সাধারণত বাকিতেই পতাকা আনেন তিনি। পরে বিক্রি শেষ হলে টাকা দেন জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, “বিক্রি-বাট্টা ভালো হলে প্রতিদিন আড়ত থেকে মাল আনতে হয়। এবারতো একবার মাল এনে ৪ দিনেও বেঁচে শেষ করতে পারি না।”

মিজানুরের মতোই হেঁটে হেঁটে পতাকা বিক্রি করেন নুরুল ইসলাম। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মাত্র ৫ দিন আগে ঢাকার বাড্ডা এলাকার একটি মেসে উঠেছেন। বছরের অন্যান্য সময় গ্রামে কৃষিকাজ করলেও বিজয় দিবসে ঢাকায় ফেরি করতে আসেন তিনি। গত ২০ বছর ধরেই চলছে এমন।

নুরুল ইসলাম জানান, তার গ্রামেরই একজন সদরঘাটে পতাকার পাইকারি ব্যবসা করেন। তার অনুরোধে ২০০৪ সালে বিজয় দিবসের আগে প্রথম ফেরি করে পতাকা বিক্রি শুরু করেন তিনি।

সকাল সন্ধ্যাকে নুরুল ইসলাম বলেন, “প্রথমবারে মাত্র ৫-৬ দিন পতাকা বিক্রি করে ভালো আয় হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর বিজয় দিবসের আগে ঢাকায় চলে আসি।”

এবার জাতীয় পতাকার বিক্রি খুবই কম বলে দাবি নুরুল ইসলামেরও। বৃহস্পতিবার বিকালে মহাখালীর আমতলী এলাকায় ফুটপাতের পাশে একটি পিঠার দোকানে দাঁড়িয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, “এবার ঢাকা আইসা মনে হয় ধরা খাইলাম। ৫ দিন হয়ে গেল তেমন বেচা-বিক্রি নাই, ইনকামও নাই। দুপুরে খাওয়ার টাকাও উঠতেছে না। দেহেন না চিতই পিঠা খায়া পেট ভরাইতেছি।”

এবার এমন হওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না স্বল্পআয়ের এই মানুষটি।

পতাকা বিক্রি কম কেন, এমন প্রশ্নে নুরুল ইসলাম বলেন, “ক্যামনে কমু পতাকা ক্যান বিক্রি হইতেছে না। আগে বিজয় দিবসে মানুষ শক কইরা গাড়ি, বাড়ি, দোকান, অফিসে জাতীয় পতাকা টানাইতো। এইবার কয়টা গাড়ি-বাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখছেন? আমার তো চোখে পড়তেছে না। ক্যান এমন হইতেছে বুঝতেছি না।”

পাইকারি ব্যবসায়ীরাও হতাশ

কদিন আগেও জুলাই আন্দোলনের সময়ে মানুষের হাতে হাতে দেখা গেছে জাতীয় পতাকা। কিন্তু বিজয় দিবস আসলেও পতাকা বেচা-বিক্রির এমন হাল দেখে শুধু খুচরা বিক্রেতারা নয়, হতাশ পাইকারি বিক্রেতারাও।

ঢাকার গুলিস্তানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা পাইকারি বিক্রি করেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন সাগর। শুক্রবার দুপুরে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে ছিলেন তিনি।

পতাকা নিয়ে কথা বলায় শুরুতে এই প্রতিবেদককে ক্রেতা ভেবে খুশিই হন তিনি। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে যেন কিছুটা হতাশ হন।

তারপরও মুখে হাসি ধরে রেখে ইসমাইল হোসেন সাগর বললেন, “ভাবছিলাম কাস্টমার আসছে, বনি-টনি (দিনের প্রথম বিক্রি) করতে পারমু।”

অতীত আর বর্তমানের চিত্র উঠে আসে তার বক্তব্যেও, “আগে ডিসেম্বরের শুরু থেকে দম ফেলার সময় পাওয়া যাইতো না, আর এইবার মাছি তাড়াইতেছি। দুপুর হয়ে গেল এখনও বনি করতে পারলাম না।”

তিনি জানান, আগের বছরও এ সময় দিনে অন্তত ৫০ হাজার টাকার বেচা-বিক্রি হতো। গতকাল সেখানে বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার টাকার।

হতাশার সুরে সাগর বলেন, “কয়েকদিন ধরেই এমন চলতেছে। আজ মনে হয় সেটাও হবে না।”

সাগরের পাশেই ছিলেন আরেক পাইকারি বিক্রেতা মো. আল আমীন। তার অবস্থাও একইরকম।

তিনি বলেন, “এবার মানুষজনের মধ্যে বিজয়ের উল্লাস কম মনে হইতেছে। বাড়ি-গাড়ি, দোকানপাট-অফিস, রিকশায় কোথাও পতাকা টানানো দেখতেছি না। আগে তো বিজয় দিবসের আগে ফিফটি পার্সেন্ট বাড়ি-গাড়িতে পতাকা টানাইতো। এইবার সেটা চোখে পড়তেছে না।”

৫ বছর ধরে পতাকার ব্যবসা করছেন, আগে কখনও এমন অবস্থা হয়নি জানিয়ে আল আমীন বলেন, “আন্দোলনের সময়ও (জুলাই আন্দোলন ) পতাকার ভালো চাহিদা ছিল, অনেক মানুষ পতাকা কিনছে সেই সময়। এখনও সেই পতাকা তাদের কাছে আছে মনে হয়। এজন্য কেউ নতুন করে পতাকা কিনতেছে না।”

একই অবস্থা কারখানা মালিকদেরও

নাম তার কামাল হেসেন মোল্লা, কিন্তু সবার কাছে পরিচিত ‘পতাকা কামাল’ নামে। নামটি এত বেশি পরিচিতি পেয়েছে যে ভিজিটিং কার্ডেও নিজের নাম ‘পতাকা কামাল’ লিখেছেন এই ব্যবসায়ী।

২০০১ সালে ঢাকার কদমতলীর মেরজানগরে পতাকার কারখানা শুরু করেছিলেন কামাল হোসেন মোল্লা। সেই কারখানায় ৬ জন শ্রমিক সারা বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা বানান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা তার কারখানা থেকে পতাকা নিয়ে যান। এবার বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকার বিক্রি এতই কম যে তার কারখানার শ্রমিকদের বেতনও বকেয়া পড়ে গেছে।

তার ভাষায়, “এবার ব্যবসা খুব ড্যামেজ। প্রচুর মাল বানায়া রাখছি, কিন্তু বিক্রি নাই। এখন দিনে কারখানা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারছি। অথচ অন্য সময়ও দিনে দেড় লাখ টাকার বিক্রি হয়।”

পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা যারা কয়েকদিন আগে মাল নিয়েছিল, তারা আর নতুন মাল নিতে আসছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “তার মানে তাদের বিক্রি কম, তারা ভালো নাই। ওরা ভালো না থাকলে তো আমরাও ভালো থাকি না।”

অন্যান্য বছর এ সময় সারা দেশের অনেক স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত থেকে পতাকা কেনার বায়না আসতো।

এবার সেটাও প্রায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “এরই মধ্যে অনেক টাকা ঋণে পড়ে গেছি। চালানই উঠাইতে পারতেছি না, লাভ হবে ক্যামনে।”

তবে এবার পতাকা বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ সবার জানা বলেই মনে করেন কামাল হোসেন।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বিজয় দিবসে পতাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের যে উচ্ছ্বাস থাকে, এবার তা নাই। রিকশাওয়ালা-ড্রাইভাররাও আবেগে ২০ টাকা দিয়ে একটা পতাকা কিনে গাড়ির সামনে লাগাইতো, এবার সেটা চোখ পড়তেছে না। আমার মনে হয় মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম কমতেছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত