Beta
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫

যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে

উম্মে রায়হানা। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

আমাদের জীবনে মার্চ মাস মানে স্বাধীনতার মাস। যে সব দেশ ও জাতি আগে অন্য দেশ বা জাতির দখলে ছিল এবং যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সে সব জাতির জন্য স্বাধীনতা দিবস উদযাপন বিশেষ আনন্দ ও গর্বের।

এখনকার সময়ে মার্চ এলে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পাশাপাশি ‘নারী দিবস’ নিয়েও বেশ আলাপ আলোচনা চলে। এই আলোচনা অবশ্য কোনও বিশেষ দেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক। বিষয়টি মন্দ নয়, যদিও অনেকেই জানেন না নারী দিবসের ইতিহাস। নারী দিবসকে নারীত্ব উদযাপনের একটি বিশেষ দিন বলে মনে করেন অনেকেই। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অনেকেই ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’ বলে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানান। এতে দোষ নেই। কিন্তু শ্রমিক নারীর মানবিক কর্মঘণ্টার দাবি এবং মজুরি বৈষম্য নিরসনের জন্য পথে নেমে শহীদ হবার ইতিহাস সামনে না এনে ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় কেমন যেন বেমানান। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারী দিবসকে ছিনতাই করে এই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। শ্রম দিয়ে ন্যয্য মজুরি পাবার পাবার দাবিতে পথের মধ্যে পুলিশের গুলিতে মরে যাওয়ার দিন নারীর জন্য ‘হ্যাপি’ হয় কী করে? আমি নিশ্চিত অনেকে এ-ও জানেন না যে পুরো মার্চ মাসটাই নারীর ইতিহাসের মাস বা ‘উইমেন হিস্টরি মান্থ’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। নারীর দ্বিতীয় মাত্রার অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য নারী দিবসের সঠিক ইতিহাস পুনঃ পুনঃ স্মরণ করবার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।

স্বাধীনতা দিবস ও নারী দিবস নিয়ে কথা শুরু করলেও আজকের লেখার বিষয় এই দুইটির একটিও নয়, বরং অন্য একটি দিবসকে কেন্দ্র করে। আর তা হচ্ছে ‘শিশু দিবস’। বাংলাদেশে ১৭ মার্চ ‘জাতীয় শিশু দিবস’ পালিত হয়। অবশ্য পৃথিবীর নানা দেশে ২০ নভেম্বর ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়। সে যাই হোক প্রতি শিশু দিবসেই নানা রকম আয়োজন থাকে। এই দিবসগুলোতে এক একটা থিম থাকে, থাকে একটা নির্দিষ্ট শ্লোগান। যেমন একবার ছিল—‘‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন।’’ এই শ্লোগানটি খুব জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।   

গত বছর যেমন বিশ্ব শিশু দিবসের থিম ছিল, ‘‘ইনভেস্টিং ইন আওয়ার ফিউচার ইজ ইনভেস্টিং ইন আওয়ার চিলড্রেন।’’ এই বছর নারী দিবসেও ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ করা নিয়েই একটি থিম ছিল মনে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিনিয়োগের ধারণা সবচেয়ে জনপ্রিয় হবে সে আর আশ্চর্য কী?

বছর বছর এমন নানা প্রতিপাদ্য নিয়ে উদযাপিত হয় শিশু দিবস ও নারী দিবস। গত বছর যেমন বিশ্ব শিশু দিবসের থিম ছিল, ‘‘ইনভেস্টিং ইন আওয়ার ফিউচার ইজ ইনভেস্টিং ইন আওয়ার চিলড্রেন।’’ এই বছর নারী দিবসেও ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ করা নিয়েই একটি থিম ছিল মনে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিনিয়োগের ধারণা সবচেয়ে জনপ্রিয় হবে সে আর আশ্চর্য কী? বিনিয়োগের সরাসরি সম্বন্ধ রয়েছে মুনাফার। বিনিয়োগ থাকলেই মুনাফা থাকবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য যেহেতু সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন, সুতরাং মানুষকে এভাবে অনুপ্রাণিত করাটাই সহজতর। নারী বা শিশুর ওপর বিনিয়োগ করবার কথা জাতিসংঘ লোককে শেখাচ্ছে, এই বিনিয়োগে যে মুনাফা আসবে সেটা সরাসরি অর্থ নয়, বরং তার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু।

স্কুল কলেজে পড়বার সময় নানা বিখ্যাত, পণ্ডিত, বীর ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের বাণী আমাদের জানতে হতো। বর্তমান শিশুদেরও জানতে হয় কিনা আমি নিশ্চিত নই। তেমনই এক বাণী ছিল এই রকম—‘‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’’ নেপোলিয়নের এই বাণীটিকে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাবার জন্য প্রায়শই উদ্ধৃত করা হলেও এই কথাটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনওদিনই একটি মানবিক ডাক হিসেবে পাঠ করিনি। বরং সবসময়ই মনে হয়েছে এই উপকারের পেছনে রয়েছে অভিসন্ধি। মাকে শিক্ষিত করে শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষিত করে নেওয়ার জন্যই জনগণের (বলা ভালো পুরুষদের) প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন ওই নেতা। নারী দিবস ও শিশু দিবসের প্রতিপাদ্যে ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগের ধারণাটিও ওই রকমেরই একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনার অংশ। তাতে সমস্যা কিছু নেই, উদ্দেশ্য যা-ই হোক, নারী ও শিশু সমাজের অনগ্রসর এবং অবহেলিত অংশ। এই অংশের উন্নতির জন্য কাজ হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় এই কাজগুলোতেও থাকে টার্গেট গ্রুপ। পণ্য বিক্রিতে যেমন নির্দিষ্ট বাজারকে বিবেচনায় রেখে বিজ্ঞাপন ও বিপণন পরিকল্পনা করা হয়, শিশু দিবসও তেমন সমাজের সুবিধাভোগী অংশকে শিশুদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। আমরা যারা এই অংশে পড়ি, তারাই কেবল বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছি।

বৈশ্বিক বিবেচনায় বলা যায়, বিশ্ব শিশু দিবসে আফগানিস্তানের বা ফিলিস্তিনের গাজার শিশুদের নিয়ে কিছুই করা হবে না। ইউনিসেফের একটি পরিসংখ্যান বলছে ২০০৫ সাল থেকে থেকে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ২৮, ৫০০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে যা পৃথিবীতে মোট শিশুমৃত্যুর শতকরা ২৭ ভাগ। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের জেরে বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর একটি অংশের শিশুরা মরে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের শিশুরা যেন জন্মায়ই মরে যাওয়ার জন্য। সে দেশের নারী-পুরুষ হয়ত প্রতিবার মিলিত হবার সময়ই জানেন তাদের অনাগত সন্তানটি বোমার  আঘাতে প্রাণ হারাতে পারে। প্রায় একই কথা প্রযোজ্য ফিলিস্তিনের গাজার শিশুদের ক্ষেত্রে। এবার গাজায় ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ফিলিস্তিনি শিশুদের গণমৃত্যুর খবর ও ছবি যতটুকু বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে সেটুকুই এই পৃথিবীতে কতটুকু মানবিকতা আছে তা বোঝার জন্য যথেষ্ঠ।  

আমরা যারা দুনিয়ার অন্যতম দূষিত নগরী ঢাকায় শিশু জন্ম দিয়েছি, তাদের অনেকেই যেমন জানি, আট মাস থেকে শুরু করে আট বছর বয়সী শিশুটির শ্বাসকষ্ট কমাতে মাঝরাতে নেবুলাইজ করতে দৌড়াতে হতে পারে হাসপাতালে, তেমনই আফগান বা ফিলিস্তিনি বাবাটি হাত পা উড়ে যাওয়া শিশু কোলে হাসপাতালে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েই পিতা হন, আফগান আর ফিলিস্তিনি মা-ও ছিন্ন ভিন্ন সন্তানের শরীরের অংশ কুড়িয়ে জড়ো করে কবর দেওয়ার সাহস নিয়েই সন্তান গর্ভে ধারণ করেন।  

এই লেখার শিরোনামে একটি গানের লাইন ব্যবহার করেছি। আমাদের দেশের স্বাধীনতার গান, গানটির প্রথম লাইন হচ্ছে, ‘‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’’ এই গানেরই এক অংশে বলা হয়, ‘‘যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে, যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে।’’ এই গানের ন্যারেটিভ কিছু না বলেও ‘মুক্তিযোদ্ধা মাত্রই পুরুষ’ এমন একটি ধারণা দেয়। যারা যুদ্ধ করছেন তারা নিজের কমিউনিটির নারী ও শিশুদের রক্ষা করবার জন্যই যুদ্ধ করছেন। এইভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় যৌন নির্যাতন সহ্য করা নারী (যাদের পরবর্তীতে বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়েছিল) উভয়কেই অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।

আমরা যারা দুনিয়ার অন্যতম দূষিত নগরী ঢাকায় শিশু জন্ম দিয়েছি, তাদের অনেকেই যেমন জানি, আট মাস থেকে শুরু করে আট বছর বয়সী শিশুটির শ্বাসকষ্ট কমাতে মাঝরাতে নেবুলাইজ করতে দৌড়াতে হতে পারে হাসপাতালে, তেমনই আফগান বা ফিলিস্তিনি বাবাটি হাত পা উড়ে যাওয়া শিশু কোলে হাসপাতালে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েই পিতা হন, আফগান আর ফিলিস্তিনি মা-ও ছিন্ন ভিন্ন সন্তানের শরীরের অংশ কুড়িয়ে জড়ো করে কবর দেওয়ার সাহস নিয়েই সন্তান গর্ভে ধারণ করেন।

আধিপত্যবাদী মূলধারা এইভাবেই মানবজাতির কিছু অংশকে অদৃশ্য করে দেয়। যেমনটা পাচার হয়ে যৌনকর্মী হয়ে যাওয়া শিশুরা বা কফি এবং চকলেট উৎপাদনে কর্মরত শিশু শ্রমিকরা অথবা উটের জকি হিসেবে বা চাইল্ড পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহৃত শিশুরা দিনের পর দিন অদৃশ্য হয়ে থাকে। যেমনভাবে বর্তমান দুনিয়ায় শ্রমিক নারীর দাবি দাওয়া এক পাশে সরিয়ে রেখেই পালিত হচ্ছে নারী দিবস। বছরে একদিন সব নারী ক্রু নিয়ে বিমান আকাশে উড়ছে, কিন্তু সেলাই মেশিনে কাজ করতে করতে ভবন ধ্বসে পঙ্গু হয়ে যাওয়া নারী শ্রমিকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।

তেমনই বোমায় প্রতিদিন মরে যাওয়া ফিলিস্তিনি বা আফগান শিশুদের, কোকো উৎপাদনে, পর্নোইন্ডাস্ট্রিতে, যৌনপল্লীতে শ্রম দেওয়া শিশুদের অদৃশ্য করে রেখেই বছরের পর বছর পালিত হচ্ছে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক শিশু দিবস। একইভাবে আমাদের দেশে এবারের জাতীয় শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য—‘‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ধরে আনব হাসি সবার ঘরে।’’ কিন্তু একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের দারিদ্রসীমার নিচে বসবসাকারী লাখ লাখ শিশুর ঘরে এই হাসি কবে পৌঁছাবে আমরা তা জানি না। যেমন আমরা জানি না, ঢাকাসহ দেশের সব বড় বড় শহরের ছিন্নমূল শিশুরা, কলে-কারখানায় সস্তা শ্রমিকের কাজ করে করে রুগ্ন হয়ে যাওয়া শিশুরা কবে ঘর পাবে আর সেই ঘরে কবে তারা হাসবে।      

যে শিশুদের মায়া হাসিতে আমাদের বিশ্ব ভোলে, ওই শিশুরা তার বাইরে, আমরা আজীবন ওদের বাইরে রেখে দিয়েই দেশে দেশে পালন করি শিশু দিবস।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
ইমেইল: ummerayhana@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত