‘সুপার সানডে’ ঘোষণা দিয়ে হামলা, ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা দিয়ে পাল্টা হামলা; সেই সঙ্গে ভাংচুর-লুটতরাজ; পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, তাতে জড়িত ঢাকার ৩৭টি কলেজ। এসব কিছুর সূত্রপাত একটি মৃত্যু থেকে।
এই মৃত্যু অভিজিৎ হাওলাদারের। শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার তারুলিয়া সামন্তসার গ্রামের ১৮ বছরের এই তরুণ ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার ডক্টর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পড়তেন, থাকতেন কাছের মাতুয়াইলে একটি ছাত্র হোস্টেলে।
কিছুদিন আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল অভিজিৎকে। গত ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হলেই দেখা দেয় ক্ষোভ-বিক্ষোভ।
কলেজ সতীর্থদের দাবি, চিকিৎসাধীন অবস্থায় খিঁচুনি দেখা দিলে চিকিৎসকরা অভিজিৎকে মাদকাসক্ত বলে সন্দেহ করেছিলেন। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে নেওয়া হয় আইসিইউতে। ভুল চিকিৎসার কারণেই তার মৃত্যু হয়।
তবে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের প্রশাসন এবং চিকিৎসকরা দাবি করছেন, অভিজিতের চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি ছিল না, বরং তারা সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, গত ১২ অথবা ১৩ নভেম্বর অভিজিৎ সেখানে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। তখন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। ফের আসেন ১৬ নভেম্বর। সেদিন তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
ওয়ার্ডে থাকাকালে চেতনাহীন হয়ে পড়েছিলেন অভিজিৎ, তার খিঁচুনি হয় এবং অক্সিজেনের মাত্রাও কমে গিয়েছিল।
সেই পরিস্থিতিতে অভিজিৎকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া প্রয়োজন মনে করেছিলেন চিকিৎসকরা।
ন্যাশনাল মেডিকেলের আইসিইউর প্রধান ডা. অনীক দে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আইসিইউর কথা শুনে তার পরিবার কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে যায়। তখন তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথাও ভাবেন। কিন্তু তার বাবা কিছুটা সময় চান।
“তিনি বোধহয় কারও থেকে সহযোগিতা পাবেন, এমন কথা বলে সময় নেন। সেখান থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। সিদ্ধান্ত নিতে নিতে রাত হয়ে যায়।”
১৭ নভেম্বর মধ্যরাতে অভিজিৎকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।
ডা. অনীক বলেন, “কিন্তু ততক্ষণে অভিজিৎ শকের দিকে যাচ্ছে। তার তখন হার্ট রেইট ২২০-২২৪ এর মতো ছিল, যতদূর আমার মনে পড়ে।
“ডেঙ্গুর এই অবস্থাটা দুই থেকে তিন দিনের মতো থাকে। অনেকে রিকভার করে, আবার দূর্ভাগ্যবশত অনেকে করে না।”
১৭ নভেম্বর সকালে আইসিইউতে অভিজিৎকে আগের চেয়ে ভালো দেখেছিলেন বলে জানান এই চিকিৎসক।
“চেতনাহীন অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলেন কিছুটা, কিছু কথার উত্তর দিতে পারলেও কিছু পারছিলেন না। অর্থাৎ আগের সংজ্ঞাহীনতার পুরোটা কাটাতে না পারলেও কিছুটা উন্নতি হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, অভিজিতের ‘ল্যাকটেট লেভেল’ ছিল স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি।”
অভিজিতের ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেনেস (এলডিএইচ) পরীক্ষা করে তা ৭ এর ওপরে পেয়েছিলেন চিকিৎসকরা। এলডিএইচ একটি এনজাইম, যা দেহে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়ায়।
ডা. অনীক দে বলেন, “চিকিৎসা বিজ্ঞানে ল্যাকটেট লেভেল সুস্থ মানুষের শরীরে স্বাভাবিক ধরা হয় ১ এর নিচে। কিন্তু ২ পর্যন্ত আমরা টলারেবল ধরি। কোনও রোগী যখন শকে থাকে, তখন ল্যাকটেট লেভেল গুরুত্বপূর্ণ একটা মার্কার হিসেবে দেখা হয়।
“অভিজিতের ল্যাকটেট লেভেল ছিল সাতের ওপরে, আটের নিচে। এতেই বোঝা যায়, অভিজিতের অবস্থা কতটা খারাপ ছিল। ধীরে ধীরে তার সব অর্গান ইনভলবড হতে থাকে। আর এতেই তিনি ডেঙ্গুর পরবর্তী ধাপে চলে যান। যাকে বলা হয় এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিন্ড্রোম। এতে তার শরীরে সব অর্গান কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মোট কথা, অভিজিতের লাং, হার্ট, লিভার, কিডনি সব বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। আর এই অবস্থায় মৃত্যু হারই বেশি।”
সার্বিক অবস্থা তার পরিবারকে জানানো হয়েছিল জনিয়ে ডা. অনীক বলেন, “১৮ বছরের একটা ছেলে, পরিবারের মানুষগুলোকে দেখছি, সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার বোন, মামাকে সব জানানো হয়।”
১৮ নভেম্বর সকালে অভিজিতের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। তখন তার মামার সম্মতি নিয়ে তাকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেন চিকিৎসকরা।
ডা. অনীক বলেন, “কিন্তু লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পর রোগী থেকে যেভাবে রেসপন্স আসার কথা ছিল, সেটা পাচ্ছিলাম না। সেটাও আমরা পরিবারকে জানিয়েছি।
“দেখতে পাচ্ছিলাম, তার হার্টরেইট কমে যাচ্ছে, তার হৃদযন্ত্র কাজ করা কমিয়ে দিচ্ছে…এই অবস্থা থেকে উন্নতি খুব কঠিন, এটাও বলেছি পরিবারকে। সব কিছুতো ডাক্তারদের হাতে থাকে না, আস্তে আস্তে সব থেমে গেল।”
সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে অভিজিতের মৃত্যু হয়। তারপর সেদিনই এক দফা হামলা হয় ন্যাশনাল মেডিকেলে।
অভিজিতের সহপাঠিরা এসে আইসিইউতে কেন নিতে হলো, সেই প্রশ্ন রেখেছিল জানিয়ে ডা. অনীক বলেন, “কেউ এসে অভিজিতের মেডিকেল ডকুমেন্টসগুলো দেখুক। প্রয়োজনে তাদের পরিচিত চিকিৎসক দিয়ে দেখাক, বিদেশে পাঠাক।”
অভিজিতের পরিবারের কারও সঙ্গে হাসপাতালের কারও কোনও বাদানুবাদ হয়নি বলে জানান এই চিকিৎসক।
“তাহলে শিক্ষার্থীরা কিসের ভিত্তিতে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে? সেদিন তারা (অভিজিতের পরিবার) মৃতদেহ নিয়ে গেল। এরপর রাতের বেলায় কয়েকজন এসে বন্ধু পরিচয়ে ঘটনার শুরু করল,” বলেন ডা. অনীক।
“তারা আসলেই অভিজিতের বন্ধু কি না, সেটাও জানি না আমরা। কারণ এই পুরোটা সময়ে আমরা অভিজিতের পরিবারকেই শুধু দেখেছি।”
পুলিশ জানিয়েছে, ১৮ নভেম্বর অভিজিতের মৃত্যুর পর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের কিছু শিক্ষার্থী এসে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভাংচুর চালায়। এরপর ২০ নভেম্বর আবার আসে হাসপাতালে। তখন হাসপাতালের পরিচালক ৪ জন চিকিৎসক ও দুজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে অভিজিতের চিকিৎসার বিষয়াদি যাচাই করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে।
সেদিন সন্ধ্যার পর পাশের শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি বাধে। তাতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্র আহত হয়।
তার পাঁচ দিন পর রবিবার দুপুরে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা পুনরায় ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালে ভাংচুর চালায়। এক পর্যায়ে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজেও ভাংচুর এবং লুটপাট চালায়।
তার জের ধরেই সোমবার সকালে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের প্রায় ১২/১৫ হাজার শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটাসহ জড়ো হয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে গিয়ে হামলা-ভাংচুর চালায়।
পুরো ঘটনায় জড়িয়ে পড়া ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার একটি সংবাদ সম্মেলন করা হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেজাউল হক।
তিনি সোমবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথমে ছয়জনের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেখানে একজন শিক্ষার্থী ও একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও ছিলেন। এরপর তারা কমিটিতে তাদের আরও লোক রাখতে চায়।
“আমরা তাদের বলেছিলাম, আপনাদের ভেতর থেকে একজন অথবা যতজন ইচ্ছা চিকিৎসক রাখুন, যিনি ডেঙ্গু বোঝেন। কিন্তু সেই নাম তারা আজও (২৫ নভেম্বর) দেননি। এরপর কমিটি করা হয় ১১ সদস্যের। তারা তদন্ত করছে।”
অভিজিৎকে বাঁচাতে হাসপাতালের চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছিলেন দাবি করে ডা. রেজাউল বলেন, “অভিজিতের বাবা হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে ছিলেন একদিন, যেদিন ছাত্ররা আসে। এরপর তাকে আর দেখিনি, তিনি আসেননি। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ অভিযোগও করেনি।”