বিজিবি নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করে সারাদেশে সেনা মোতায়েন করেছে সরকার।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সহিংস আন্দোলনে শতাধিক মৃত্যুর পর শুক্রবার রাতে সরকারের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত আসে।
এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ক্ষমতাবলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহানগর এলাকার পুলিশ কমিশনাররা সান্ধ্য আইন জারি করেছেন।
প্রথম দফায় শুক্রবার মধ্যরাত ১২টা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটানা কারফিউ চলে। এরপর দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দুপুর ২টা থেকে রবিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল ছিল। এরপর দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার কারফিউ শুরু হয়।
সোমবার দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা বিরতি ছিল। এরপর মঙ্গলবারও দুপুরের পর কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার কারফিউ চলছে সারাদেশে।
কারফিউর মধ্যে একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনে বের হয়ে ধরা পড়লে শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্সসহ সব জরুরি সেবার কর্মী ও বাহন, খাদ্য ও জ্বালানি পরিবহনকারী বাহন, সংবাদমাধ্যমের কর্মী ও বাহন কারফিউর মধ্যেও চলতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা অনুযায়ী বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে ঢাকায় সেনাসদস্যদের দেখা যাচ্ছে। সড়কে সাঁজোয়া যান নিয়ে টহল দিচ্ছে তারা। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে সেনা সদস্যরা অবস্থান নিয়ে আছে। কেউ বেরুতে চাইলে তাকে গলিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তারা।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার সান্ধ্য আইন জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনে বাধ্য হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর পর্যন্ত কারফিউ চলবে।
এদিকে কারফিউ জারির পর রবি ও সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে মঙ্গলবারও ছুটি ঘোষণা করা হয়। ফলে অফিস-আদালত বন্ধ রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগে থেকে বন্ধ রয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবির এই আন্দোলন রাজপথে গড়িয়েছিল প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। গত মাসে হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহালের রায় দেওয়ার পর জুলাইয়ের শুরুতে কর্মসূচি দিয়ে সড়কে নামে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ কেন্দ্রিকই ছিল এই আন্দোলন। ধীরে ধীরে তার পরিসর বেড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ে।
গত সোমবার (১৫ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা আক্রান্ত হওয়ার পরদিন বুধবার সহিংস হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। তাতে ঢাকায় একজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়।
পরদিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সব ছাত্রাবাস খালি করার নির্দেশ দেয়। তার প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক বনধ কর্মসূচি ডাকলে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। তাতে অন্তত ৪১ জন নিহত হয়।
একই কর্মসূচি চলতে থাকলে পরদিনই সহিংসতা আরও বাড়ে। তাতে নিহত হয় অর্ধ শতাধিক। বিটিভি, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, মেট্রো স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়; জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা শহরের অসংখ্য পুলিশ বক্স। মেট্রোরেলের পাশাপাশি রেল চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
অবনতিশীল পরিস্থিতিতে সরকার বুধবারই বিজিবি নামিয়েছিল ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে। তারপরও সংঘাতের বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে কারফিউ জারি করে প্রতিরক্ষা বাহিনী নামানো হলো।