Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

অ্যালেক্সেই নাভালনি : যে নাম কখনও মুখে নেননি পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনি। ছবি: বিজনেস ইনসাইডার।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনি। ছবি: বিজনেস ইনসাইডার।
[publishpress_authors_box]

অ্যালেক্সেই নাভালনি। ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে কট্টর এবং নির্ভীক সমালোচক। সমর্থকরা তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তুলনা করতেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল, তিনি একদিন জেল থেকে মুক্ত হয়ে রাশিয়ার নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তার আগেই তিনি মারা গেলেন।

বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর কারাগার হিসেবে পরিচিত দুর্গম উত্তর মেরু অঞ্চলের পেনাল কলোনিগুলোর একটিতে বন্দি অবস্থায় গতকাল শুক্রবার তার মৃত্যু হয়।

কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার হাঁটাহাটি শেষে ৪৭ বছর বয়সী নাভালনি হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে যান। চিকিৎসকরা আর তার জ্ঞান ফেরাতে পারেননি।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে রাশিয়ার একটি আদালত তাকে ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়। এরপর থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, পুতিন যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন তার মুক্তি পাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই।

২০২১ সাল থেকেই তিনি কারাগার ও হাসপাতালে ছিলেন। তার ওপর গোপনে বিষ প্রয়োগের অভিযোগও উঠেছিল পুতিনের গোয়েন্দাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

তার এই অকাল মৃত্যুর জন্য ক্রেমলিনই মূলত দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ফন ডের লিয়েন।

আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দাবি, পুতিনই হত্যা করেছেন নাভালনিকে।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের মতে, অত্যাধিক সাহস দেখানোর মূল্য জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে তাকে।

অ্যালেক্সেই নাভালনি কে

১৯৭৬ সালে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর পশ্চিমের একটি গ্রামে জন্ম অ্যালেক্সেই নাভালনির। তবে তার বেড়ে ওঠা মস্কোর ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর ওবনিনস্কে। ১৯৯৮ সালে তিনি মস্কোর পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতক পাস করেন।

এর এক দশক পর রাশিয়ার রাজনীতিতে বিরোধী শক্তি হিসেবে তার উত্থান শুরু। মূলত রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পান। রাশিয়ার বড় বড় রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত করপোরেশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্লগ লিখে তিনি তার মিশন শুরু করেন।

তার কৌশলগুলোর মধ্যে একটি ছিল বড় তেল কোম্পানি, ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়গুলোতে শেয়ারহোল্ডার হয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার ফাঁকফোকর নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তার অভিযোগ, পুতিনের দল দুর্নীতিবাজে পূর্ণ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দপ্তর ক্রেমলিনকে একটি ‘সামন্ত দুর্গ’ বলে আখ্যায়িত করে পুতিনকে তিনি মধ্যযুগের জারদের সঙ্গে তুলনা করেন। তার দাবি, পুতিন ও তার সরকার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মাধ্যমে রাশিয়ার রক্ত চুষে নিচ্ছে।

নাভালনি তরুণ রুশদের মুখের চলতি ভাষায় কথা বলতেন। বাচনভঙ্গি ও স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য সোশাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা পান তিনি। তার দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশন (এফবিকে) রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ফাঁস করত।

২০১১ সালে তিনি পুতিনের বিরুদ্ধে বড় বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এরপর থেকে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাকে জেলে বা হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। তার সংগঠনকে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধও করা হয়।

২০১৭ সালে জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়াতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। সেসময় প্রেসিডেন্ট পুতিনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একমাত্র প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হন নাভালনি।

বেশ কয়েকবার হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যান তিনি। রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নাভালনি বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট হতে চাই, কিন্তু রাশিয়ায় কোনও নির্বাচন হয় না।”

পুতিনসহ অভিজাতদের দুর্নীতি ফাঁস

পুতিনসহ দেশটির অভিজাত ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার চিত্র তুলে ধরেন নাভালনি। ইন্টারনেট ও ড্রোন ব্যবহার করে তাদের বিশাল সম্পদ ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের ছবি ফাঁস করেন।

২০১১ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম বিরোধী নেতাদের একজন ছিলেন নাভালনি।

নাভালনির অভিযোগ, পুতিন ব্যক্তিগত শাসনের এমন একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন যা মূলত চাটুকারিতা ও দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে।

২০১২ সালে নাভালনি তার ব্লগে লিখেছিলেন, “রাশিয়ার প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের সময় দুর্নীতি ছিল সমস্যাযুক্ত, আর পুতিনের সময় তা পদ্ধতিগত হয়ে ওঠে।”

২০১১ সালেও রয়টার্সকে নাভালনি বলেছিলেন, “বর্তমান রাশিয়ার ভিত্তি হলো দুর্নীতি, যা পুতিনের রাজনৈতিক ক্ষমতারও ভিত্তি।”

আল জাজিরার প্রতিবেদন বলছে, প্রথমে একজন লাইভজার্নাল ব্লগার হিসেবে তিনি তার দুর্নীতিবিরোধী প্রচার শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে একটি গবেষক দল গড়ে তোলেন। ব্যাংক রেকর্ড, ফাঁস হওয়া নথি, মানচিত্র, সম্পত্তির ব্লুপ্রিন্ট, ড্রোনের মাধ্যমে তোলা ছবি ও ভিডিও ফুটেজসহ কয়েক ডজন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তার টিম।

এসব প্রতিবেদনে রাশিয়ার অভিজাতদের দেশে ও বিদেশে বিলাসবহুল জীবন-যাত্রার চিত্র ফাঁস করা হয়। পুতিনের ঘনিষ্ঠ অভিজাত ব্যক্তিদের বিদেশি পাসপোর্ট ও বহু বিলিয়ন ডলারের সম্পদ, তাদের পরিবারের অপ্রত্যাশিত সম্পদ এবং ক্রেমলিন-নিয়ন্ত্রিত করপোরেশনে বিশাল বেতনে চাকরির তথ্যও তুলে ধরা হয়।

সোশাল মিডিয়া ও ইউটিউবে এসব প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়লে তাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে একাধিকবার জেলে পাঠানো হয়।

২০১৫ সালে রাশিয়ার ক্যারিশম্যাটিক বিরোধী নেতা বরিস নেমতসভের হত্যাকাণ্ডের পর পুতিন বিরোধীরা নাভালনির প্রতি আকৃষ্ট হন।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক পাভেল লুজিন আল জাজিরাকে বলেন, “যারা পুতিনের শাসন ছাড়া কিছুই দেখেননি এবং বর্তমান ব্যবস্থার অধীনে যাদের কোনও অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই, এমন তরুণরা নাভালনির সমর্থক ছিল। এছাড়া যারা বরিস ইয়েলৎসিন ও পুতিনের শাসনে কোনও সুবিধাভোগী হননি তারাও নাভালনিকে সমর্থণ জানায়।”

যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর তকমা

পুতিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিশাল ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা নিয়ে নাভালনি যে অভিযোগ আনেন ক্রেমলিন তা খারিজ করে। তার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। তার সহযোগীদের বেশিরভাগ রাশিয়া থেকে পালিয়ে ইউরোপে বসবাস করছেন।

রাশিয়ার কর্মকর্তারা নাভালনিকে একজন চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চর বলে তকমা দেয়। পুতিন প্রশাসনের অভিযোগ, নাভালনি রাশিয়াকে দুর্বল ও পশ্চিমের মক্কেল রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিপ্লবের বীজ বপন করার চেষ্টা করছিল।

দুর্নীতিবিরোধী জনসমাবেশ করায় উল্টো তার বিরুদ্ধেই দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও জালিয়াতির অভিযোগ এনে নাভালনিকে অসংখ্যবার আটক ও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।

নাভালনির বিরুদ্ধে পুতিনের পাল্টা প্রচার

পুতিন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া তাকে বিশ্বাসঘাতক ও ন্যাটোর গুপ্তচর বলে আখ্যায়িত করে পাল্টা প্রচার চালায়। তাকে এমনকি একজন রাজনৈতিক ‘শিশুকামী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ তার ডাকে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী পুতিনবিরোধী বিক্ষোভে সমাবেশে যোগ দিয়েছিল।

এই পাল্টা প্রচার বেশ কাজেও লাগে। মস্কোভিত্তিক মতামত জরিপ সংস্থা লেভাদা সেন্টারের ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ১৯ শতাংশ রুশ নাভালনির কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানায়। আর ৫৬ শতাংশই তার বিরোধিতা করে।

তার মানে এতোকিছু করেও তিনি খুব একটা জনপ্রিয়তা পাননি। রাশিয়ার জনগণ হয় পুতিনকে খুব বেশি ভয় পায় অথবা ভালোবাসে। যে কারণে তারা পুতিনের কোনও বিকল্প ভাবতে পারেন না।

থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি সেন্টারের আন্দ্রে কোলেসনিকভ বলেন, “রুশরা অ্যালেক্সেই নাভালনি বা অন্য কেউ তাদের অভ্যাসগত বিশ্বদর্শনকে নাড়া দিলে বিরক্ত হয়। ফলে তারা এমনকি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা সব গোষ্ঠীকে আক্রমণাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করে।”

বিষপ্রয়োগ

২০২০ সালের আগস্টে নাভালনি সাইবেরিয়ার তোমস্ক থেকে মস্কো যাওয়ার পথে বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেসময় পাইলট বিমানটি জরুরি অবতরণ করিয়ে তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। এরপর নাভালনি চিকিৎসার জন্য জার্মানির বার্লিনে যান। সেখানে ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা করে জানান, তার ওপর নোভিচক নামের সোভিয়েত আমলের একটি বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছে। এই গ্যাস মানুষের স্নায়ুগুলোকে বিকল করে দেয়।

রুশ গণমাধ্যম এ বিষয়ে একটি যৌথ তদন্তের প্রস্তাব দিলে পুতিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিছু গণমাধ্যম অভিযোগ করে, এর পেছনে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির হাত রয়েছে। এএফএসবি হলো সোভিয়েত আমলের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির উত্তরসুরি। পুতিন নিজেও কেজিবির সদস্য ছিলেন।

তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পুতিন বলেন, “যদি কেউ তাকে বিষ দিতে চাইত, তারা তাকে হত্যাই করতে পারত।”

যাই হোক, চিকিৎসা শেষে নাভালনি ২০২১ সালে জার্মানি থেকে স্বেচ্ছায় রাশিয়ায় ফেরেন। তার এই অসীম সাহসের জন্য রাশিয়ার বিরোধী শিবিরে তিনি বেশ প্রশংসিতও হন। তবে অনেকে তাকে বেপরোয়া বা অপরিণামদর্শী বলেও সমালোচনা করেন। জার্মানি থেকে ফেরার পরপরই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

পুতিন কখনও তার নাম মুখে নেননি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন জীবনে কখনও নাভালনির নাম মুখে নেননি। তার পরিবর্তে পুতিন তাকে সবসময়ই ‘সেই চরিত্র’, ‘পূর্বকথিত নাগরিক’, ‘সেই অসুস্থ ব্যক্তি’ ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ‘আশ্রিত ব্যক্তি’ ইত্যাদি নামে নাভালনির উল্লেখ করতেন।

২০১৮ সালে একদিন আল জাজিরার প্রতিবেদক মনসুর মিরোভালেভকে নাভালনি বলেছিলেন, “পুতিনের কাছে আমি হ্যারি পটার উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের প্রধান খলনায়ক লর্ড ভলডেমর্টের মতো। পুতিন আমার নাম জোরে বলতে পারেন না।”

সেদিন পুলিশ তার মস্কো অফিসে তাণ্ডব চালানোর পর তিনি একথা বলেছিলেন।

নাভালনি পুতিনের ইউক্রেন হামলারও বিরোধিতা করেন। ইউক্রেন যুদ্ধকে অর্থহীন এক নির্বোধ যুদ্ধ মনে করতেন তিনি। ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধেও নাভালনি রাশিয়ার অভিজাতদের মধ্যে ‘ইউক্রেনের প্রতি রক্তপিপাসু মোহ’ আছে বলে কটাক্ষ করেন।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স, ডেক্কান হেরাল্ড, বিজনেস ইনসাইডার, দ্য ইকোনমিস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত