নেতৃত্ব এমনিতেই চাপের। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেটা আরও বেশি। সেই চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে ব্যাটিংয়ে ছন্দ হারিয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দলও রয়েছে ব্যর্থতার বৃত্তে। ‘অধিনায়ক কোটায় দলে খেলছেন’-এমন অপবাদ পর্যন্ত শুনতে হচ্ছে তাকে। এজন্যই নির্ভার হতে অধিনায়কত্ব ছাড়ার আলোচনায় শান্ত।
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান এই ব্যাটারকেই অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে চাইছে বিসিবি। পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম জানিয়েছেন নেতৃত্ব ছাড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে শান্তর লিখিত কোনো ডকুমেন্ট না পাওয়ার কথা। পাশাপাশি শান্তকে রেখে দেওয়ার পক্ষেও তিনি, ‘‘শান্ত এতদিন ধরে ক্যাপ্টেন্সি করছে। এটা তো সময়ের ইনভেস্টমেন্ট। আমরা একজনকে তৈরি করার চেষ্টা করছি। সে যদি হঠাৎ করে সরে যায়, নতুন একজন কিছুটা অপ্রস্তুত। সেটাতে যেতে না চাওয়াই স্বাভাবিক হবে।’’
শান্ত সরাসরি এখনও নেতৃত্ব ছাড়া নিয়ে কিছু বলেননি। আজ (সোমবার) চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এলে নিশ্চিতভাবেই উঠবে প্রসঙ্গটা। এর আগে ব্যাটিংয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছেন শান্ত। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুশীলনে তার চোখে মুখে ছিল প্রত্যয়। ব্যাটিং কোচ ডেভিড হ্যাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন বেশ কিছুক্ষণ। এরপর করেছেন নেট প্র্যাকটিস। তবে ব্যাটিংয়ে ছন্দে ফেরার চেয়ে তার নেতৃত্বে থাকা না থাকা নিয়েই আগ্রহটা বেশি সবার। শান্ত কি এড়িয়ে যাবেন ব্যাপারটা? নাকি সরাসরি বার্তা দিয়ে স্বাগত জানাবেন নতুন অধিনায়ককে।
প্রশ্ন উঠছে, এক বছর না যেতেই কেন হাঁপিয়ে উঠলেন শান্ত? গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর তিন ফরম্যাটে নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাকে। শান্ত নিজে বলেছিলেন লম্বা সময় দায়িত্ব নিতে চান। তাই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত পান দায়িত্ব। সেই টুর্নামেন্টের চার মাস আগে নিজেই কেন সরে দাঁড়াতে চাইছেন শান্ত?
আসলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়া আর গতিময় ওয়াকায় ব্রেট লিকে সামলানো কিংবা চেন্নাই টেস্টের শেষ দিন অশ্বিন-জাদেজাদের স্পিন খেলার মতোই কঠিন। কারণ একজন অধিনায়ক ততটাই সফল যতটা তার দল ভালো। সেই ভালো দলটা কবে ছিল বাংলাদেশের?
শুরু থেকেই বাংলাদেশ টেস্টে নড়বড়ে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা এতদিনেও মানিয়ে নিতে পারেনি তারা। ওয়ানডেতে সমীহ জাগানিয়া কিছু সাফল্য আছে, তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বকাপ ফাইনাল বা সেমিফাইনালে কখনও খেলতে পারেনি বাংলাদেশ।
এমন দল নিয়ে ড্রেসিংরুম পরিচালনা করা সহজ নয়। মাশরাফি, সাকিব, তামিমরা সেটা পেরেছেন নিজেদের তারকাখ্যাতিতে। পারফর্মও করেছেন তারা। শান্ত তাদের মানের তারকা নন । তাই টানা ব্যর্থতায় তার জন্য ড্রেসিংরুম পরিচালনা সহজ নয়।
বারবার অধিনায়কত্ব বদল নিয়ে বিসিবিরও বদনাম ছিল শুরু থেকে। সেই ১৯৯৭ সালে আকরাম খানের নেতৃত্বে আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ। এক বছর না যেতে নেতৃত্ব তো বটেই দল থেকেও জায়গা হারিয়েছিলেন আকরাম!
বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে। দুটি অসাধারণ জয় থাকলেও দেশে ফিরে নেতৃত্ব হারান তিনিও। বাংলাদেশ ২০০০ সালে প্রথম টেস্ট খেলে নাঈমুর রহমান দূর্জয়ের নেতৃত্বে। দুই বছর না যেতে নাঈমুর অধিনায়কত্ব হারান খালেদ মাসুদ পাইলটের কাছে।
এভাবে অনেক সময়, বছর শেষ হওয়ার আগে নেতৃত্বের মিউজিক্যালে চেয়ারে বদল এসেছে বাংলাদেশে। তারই ধারাবাহিকতায় হয়তো চলে যেতে হবে শান্তকে। চট্টগ্রামে না হলেও হয়তো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর। কিংবা আরও পরে। আসবেন নতুন কেউ। এমন দল নিয়ে ব্যর্থ হবেন তিনিও। আবারও হবে পালাবদল! এই সংস্কৃতির শেষ কোথায়, জানা নেই কারও।
শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে যাওয়া চট্টগ্রাম টেস্টটা শান্তর অধিনায়ক হিসেবে শেষ অধ্যায় হয় কিনা, সেটাই দেখার। তবে পরিসংখ্যান বলছে অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে ঘরের মাঠে শান্তর ব্যর্থতার কথা। গত বছর নভেম্বরে পূর্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেতৃত্বে ৯ টেস্টের ৩টি জিতেছে বাংলাদেশ, হেরেছে ৬টিতে। এই ৬ হারের ৪টিই আবার দেশের মাটিতে।
বর্তমান অধিনায়কদের ঘরের মাঠে টেস্ট হার
অধিনায়ক | দেশ | টেস্ট | হার |
ক্রেইগ ব্রাথওয়েট | ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ১৬ | ৬ |
নাজমুল হোসেন শান্ত | বাংলাদেশ | ৫ | ৪ |
বেন স্টোকস | ইংল্যান্ড | ১৭ | ৪ |
রোহিত শর্মা | ভারত | ১৫ | ৪ |
শান মাসুদ | পাকিস্তান | ৫ | ৩ |
টম ল্যাথাম | নিউজিল্যান্ড | ৫ | ২ |
প্যাট কামিন্স | অস্ট্রেলিয়া | ১৩ | ১ |
ধনঞ্জয়া ডি সিলভা | শ্রীলঙ্কা | ৩ | ০ |
টেম্বা বাভুমা | দ.আফ্রিকা | ৩ | ০ |
ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে বিপক্ষের সঙ্গে এগিয়ে থেকে নামে প্রতিটা দল। সেখানে শান্ত বেশি ব্যর্থ ঘরের মাটিতেই। বর্তমান অধিনায়কদের মধ্যে নিজেদের দেশে ১৬ টেস্টে সবচেয়ে বেশি ৬ হার ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রেইগ ব্রাথ্রওয়েটের।
সমান ৪টি করে হার আছে নাজমুল হোসেন শান্ত, বেন স্টোকস আর রোহিত শর্মার। তবে স্টোকস খেলেছেন ১৭ টেস্ট আর রোহিত ১৫টি। সেখানে শান্তর ৪ হার ৫ ম্যাচে।
নাজমুলের নেতৃত্বে ৯ ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ৩টিতে, হার ৬টিতে। টি–টোয়েন্টি খেলেছে ২৪টি, জয় এসেছে ১০টিতে। দলের পারফর্ম যেমনই হোক বিসিবি কখনও প্রশ্ন তুলেনি শান্তর নেতৃত্ব নিয়ে। তার অধিনায়কত্ব, ফিল্ডিং প্লেসিং, বোলার পরিবর্তন-প্রশংসিতই হয়েছে বেশির ভাগ সময়। পাকিস্তানের মাটিতে ২-০’তে টেস্ট সিরিজ জয়ের সময় প্রশংসায় রীতিমতো ভাসছিলেন শান্ত।
অধিনায়ক হওয়ার পর ব্যাটে ধার হারিয়েছেন তিনি। শান্তর টেস্টে ব্যাটিং গড় ২৫.৭৬, তার ক্যারিয়ার গড় ২৮.৬৮। টি–টোয়েন্টিতে ক্যারিয়ার গড় ২২.৮৫ আর অধিনায়ক হিসেবে ১৮.৭৬। এই দুই ফরম্যাটে গড় কমলেও ওয়ানডেতে সেটা বেশি। ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার গড় ৩৩.২৯ আর অধিনায়ক হিসেবে ৫০-এর বেশি। তবে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ফিফটি পাননি দীর্ঘদিন।
পরিসংখ্যান যাই বলুক, এক বছর না যেতেই অধিনায়কত্বের মুকুটটা যে কাঁটা হয়ে বিঁধছে, শান্ত বুঝতে পারছেন ভালোভাবে। কাঁটার সেই মুকুটটা কি চট্টগ্রাম টেস্টের পরই খুলে ফেলবেন তিনি? আর মিউজিক্যালে চেয়ারের মতো অধিনায়ক বদলাতেই থাকবে বাংলাদেশে।