মজা করেই সাপের মত ফণা তুলে উদযাপন করতেন নাজমুল ইসলাম অপু। তার এই ‘নাগিন নাচ’ এখন হয়ে গেছে ‘নাগিন ডার্বি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের এমন নাম দিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াই। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ বা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ট্রান্স তাসমান সিরিজের চেয়ে কম উত্তাপ ছড়ায় না নাগিন ডার্বি।
নাজমুল ইসলামের উদযাপন কীভাবে নাগিন ডার্বি হল, সেটা জানতে ফিরে যেতে হবে ২০১৬ সালে। বিপিএলে তখন সময়টা খারাপ যাচ্ছিল রাজশাহী কিংসের। টানা হারের ধকল কাটাতে ক্রিকেটাররা মজা করছিলেন নিজেরাই। একদিন গোল হয়ে বসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্যারেন সামি, কেসরিক উইলিয়ামস, নাজমুল ইসলাম অপুরা।
রাজশাহীর টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে নির্দেশনা ছিল পাশের জন সম্পর্কে একটা ধারণা করে ছবি আঁকতে হবে। কেসরিক উইলিয়ামস নাজমুলকে দেখে আঁকেন সাপের ছবি। কারণ স্পিনাররা বলের ঘূর্ণিতে ছোবল মারেন সাপের মতই।
এরপর অনুশীলনে ড্যারেন সামিকে আউট করে সাপের মত ফণা তোলেন নাজমুল ইসলাম অপু। সামিও ভঙ্গি করেন ভয় পাওয়ার। সেই ফণা তোলার ভঙ্গি নাজমুল করেন রাজশাহীর ম্যাচে উইকেট পাওয়ার পরও। নতুন এই উদযাপনের নাম হয়ে যায় ‘নাগিন নাচ’।
রাজশাহী ছেড়ে নাজমুল ইসলাম ২০১৭ সালে যোগ দিয়েছিলেন রংপুর রাইডার্সে। সেবারও প্রথম ম্যাচে উইকেট পেয়ে করেছিলেন নাগিন নাচ। অবশ্যই মজা করে সেটা। ব্যাপারটা শেষ হতে পারত এক ম্যাচেই। কিন্তু এমন উদযাপন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নাজমুল নাম নিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজার কন্যার, ‘‘এমন উদযাপন আসলে মজা করেই শুরু হয়েছিল। রাজশাহীর নেটে সামিকে সাপের ভঙ্গি দেখালে ও ভয় পাওয়ার অভিনয় করত। রংপুরের হয়ে প্রথম ম্যাচে উদযাপনের পর হোটেলে এসেছিল মাশরাফি ভাইয়ের মেয়ে। ও বলেছিল, ‘চাচ্চু তোমার এই নাচ ভালো লাগে। এটা সবসময় করিও’। তখন থেকেই নিয়মিতই করি এই উদযাপন।”
একজন বাঁ-হাতি স্পিনারের বিশেষ উদযাপন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজে? ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেকে নাজমুল প্রথম উইকেটটি পান দানুশকা গুনাতিকালার। মিরপুরের সেই ম্যাচে স্বাভাবিকভাবেই উদযাপন করেন নাগিন নাচ-এ।
পরের ম্যাচে ২ উইকেট নিয়ে গুনাতিকালাও ব্যঙ্গ করেন নাগিনের ভঙ্গিতে । দুটি ম্যাচই হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সে সময় বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ায়, হারের জ্বালাটা বেশিই ছিল বাংলাদেশের। মুশফিকুর রহিম মনে রেখেছিলেন গুনাতিকালার উপহাস।
২০১৮ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয় ত্রিদেশীয় নিদাহাস ট্রফি। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ২১৪ রানের পাহাড় গড়েছিল শ্রীলঙ্কা। নাজমুল ইসলাম ২ ওভারে ২০ রানে ছিলেন উইকেটহীন। মুশফিকুর রহিমের ৩৫ বলে অপরাজিত ৭২ রানে উত্তেজনার ম্যাচটি ২ বল বাকি থাকতে ৫ উইকেটে জেতে বাংলাদেশ। জয়ের পর মুশফিকও করেন নাগিন উদযাপন।
এতদিন মজার ছলে সবকিছু চললেও ব্যাপারটা উত্তেজনার পর্যায়ে যায় মুশফিকের এমন উদযাপনে। ফাইনালে পৌঁছতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচে জিততে হত বাংলাদেশকে। শ্রীলঙ্কা পায় ১৫৯ রানের পুঁজি। বিস্ময়করভাবে একাদশে থাকলেও নাজমুলকে বলই দেননি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান!
ম্যাচজুড়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের চলছিল স্লেজিং। বাংলাদেশের উইকেট পড়লে গ্যালারিতে লঙ্কান দর্শকরা উদযাপন করছিল নাগিন নাচে। শেষ ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার ছিল ১২ রান।
দ্বিতীয় বলে রান আউট হন মুস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু ইসুরু উদানা টানা দুটি বাউন্সার দেওয়ায় আম্পায়ারের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন মাহমুদউল্লাহ। নিয়ম অনুযায়ী এক ওভারে দুটি বাউন্সার দেওয়া যায় না। বন্ধ থাকে ম্যাচ। মাঠে পানি নিয়ে আসা নুরুল হাসান সোহানের সঙ্গে লেগে যায় থিসারা পেরেরার। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বাংলাদেশি ব্যাটারদের ক্রিজ ছেড়ে চলে আসতে বলায়!
নানা নাটকীয়তা শেষে শুরু হয় ম্যাচ। মাহমুদউল্লা পরের তিন বলে ৪, ২ ও ৬ নিয়ে জয় এনে দেন বাংলাদেশকে।
১ বল বাকি থাকতে রুদ্ধশ্বাস ২ উইকেটের জয়ের পর মাঠে নেমে আসেন বাংলাদেশের সব ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফ। খালেদ মাহমুদ সুজনসহ দলের সবাই উদযাপন করছিলেন নাজমুলের মত নাগিন নাচের তালে।
চুপসে যায় গ্যালারি। এরপর ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশ হারলে দর্শকরা নাগিন নাচে জবাব দেয় সাকিবের দলকে। এই নাচ এমনই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ধারাভাষ্যে সুনীল গাভাস্কারের মত কিংবদন্তি পর্যন্ত মাথার উপর হাত তুলে করেছেন নাগিন নাচের ভঙ্গি।
সেই থেকে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার সিরিজ মানেই ‘নাগিন ডার্বি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর আর খেলেননি নাজমুল। এমনকি ২০১৮ সালের পর আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিই খেলেননি তিনি।
নাজমুল না থাকলেও রয়ে গেছে তার সেই নাগিন নাচ। সেই নাচের সঙ্গে মিলিয়ে সিলেটে আজ শুরু হচ্ছে আরও একটি ‘নাগিন ডার্বি’।