Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নেওয়ার আহ্বান এনবিআর পরামর্শক কমিটির

আসন্ন বাজেট সামনে রেখে বৃহস্পতিবার এনবিআর পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভা ঢাকার প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজন করা হয়।
আসন্ন বাজেট সামনে রেখে বৃহস্পতিবার এনবিআর পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভা ঢাকার প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজন করা হয়।
[publishpress_authors_box]

অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটি।

আসন্ন বাজেট সামনে রেখে বৃহস্পতিবার এনবিআর পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভা ঢাকার প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজন করা হয়। সভার আয়োজন করে এনবিআর ও এফবিসিসিআই। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান।  

সভায় সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্ব সংস্কার, আয়কর, মূসক ও আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত্র পরামর্শক কমিটির প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন- এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম।

তিনি বৈদেশিক অর্থায়ন ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যও সরকারকে অনুরোধ করেছেন।

স্বাগত বক্তব্যে মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার গত ১৫ বছরে ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নিত হয়েছে। সামনের দিকে আরও বড় হবে। অর্থাৎ এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে বেশি সময় লাগবে না। তবে সেই অনুপাতে সক্ষমতা তৈরি হয়নি।


তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ কোটি টাকা। এই জন্য রাজস্ব সংক্রান্ত আইন-কানুন প্রণয়ন, আধুনিকায়ন করা এবং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সরকার এবং বেসরকারি খাত এক সঙ্গে কাজ করার বিকল্প নেই।

আসন্ন বাজেটে প্রস্তাবনা

দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে সুদের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে প্রস্তাবনায়।

কর হার কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা; ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করতে আয়করের আওতা বাড়াতে প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

এ লক্ষ্যে এনবিআরের সমন্বিত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জরুরি সংস্কারের প্রস্তাব পরামর্শক কমিটির।

এনবিআরের রাজস্ব আহরণ ও রাজস্ব নীতি কার্যক্রম পৃথক করা এবং ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ নামে একটি বিভাগ গঠন করারও প্রস্তাব করা হয়।


বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং সিনিয়র সিটিজেন ও নারীদের জন্য ৫ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাবনা পরামর্শক কমিটির।

এছাড়া বর্তমান আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য সামগ্রী যেমন- চাল, গম, আলু, পিঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনি, সব ধরনের ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে ২ শতাংশ হারে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। এতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে। তাই সব কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতাবহির্ভূত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা তৈরি পোশাক শিল্পকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পসহ সব রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর হার ১ শতাংশ হতে কমিয়ে আগের মত শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর রাখার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি নগদ সহায়তার উপর আয়কর কর্তনের হার ১০ শতাংশ হতে হ্রাস করে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করার কথাও বলা হয়।

তৈরি পোশাক শিল্পের পোশাক প্রস্তুতপূর্বক রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে সম্পাদনের জন্য সম্পাদিত সাব-কন্ট্রাক্টের বিপরীতে ভ্যাট অব্যাহতি দিতে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট হতে পূর্বানুমোদন গ্রহণের শর্তটি সংশোধন করে আগের মতো বিজিএমইএ হতে জারিকৃত ইন্টারবন্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে সাব-কন্ট্রাক্ট কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আমদানিকারক নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রে শুল্ক চারটি স্তরে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রথম স্তরে কোন পরিবর্তন ছাড়াই সরাসরি ব্যবহৃত হয় এমন তৈরি পণ্যের সর্বোচ্চ শুল্ক ২৫ শতাংশ ক্রমান্বয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা।

দ্বিতীয় স্তরে মূসক নিবন্ধিত দেশে উৎপাদিত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ এবং মধ্যবর্তী কাঁচামালের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫-৭ শতাংশ, তৃতীয় স্তরে যন্ত্রপাতি, তালিকাভুক্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, মৌলিক এবং দেশে উৎপাদিত হয় না এমন কাঁচামাল ক্ষেত্রে শুল্ক ১-৩ শতাংশ এবং চতুর্থ স্তরে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত পণ্যের ওপর পরিমানভিত্তিক মিশ্র শুল্ক দেওয়ার প্রস্তাব তাদের।

সম্পূরক শুল্ক কেবলমাত্র বিলাস দ্রব্য, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য এবং অনভিপ্রেত দ্রব্য ব্যবহার সীমিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করার প্রস্তাব কমিটির।

আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে আমদানি সীমাবদ্ধ করার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য বা সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করারও প্রস্তাব করেন তারা।

গ্যাস বিদ্যুতের বাড়তি দাম নিয়ে ক্ষোভ ব্যবসায়ী নেতাদের

পরামর্শক কমিটির প্রস্তাবনা প্রকাশের পর মুক্ত আলোচনা অধিবেশন শুরু হয়। আলোচনা অংশগ্রহণ করে অর্থমন্ত্রীর উপর ক্ষোভ ঝাড়েন ব্যবসায়ী নেতারা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন নিজেদের ব্যবসা সরকারকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে এক্সিট পলিসি চান।

তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংক ইন্টারেস্ট, ডলার সংকট মিলিয়ে আমরা ভালো নেই। ব্যবসা নিভু নিভু অবস্থায় পৌঁছেছে। আমরা যারা আপনাদের ডলার এনে দিচ্ছি, তাদের আপনারা দেখছেন না। তাহলে আপনারা আমাদের একটা এক্সিট পলিসি করে দেন, আমরা আপনাদের ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই।

একই সুর ছিল বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি চৌধুরী জাহাঙ্গীর আলমেরও।

তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা ব্যবসা করব কীভাবে। এভাবে হলে বিনিয়োগ আসবে না, ব্যবসা হবে না। অর্থনীতি ফাঁকা হয়ে যাবে।

এ বছর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। 

তিনি বলেন, সব কিছুর দাম বাড়বে, কিন্তু আমরা পাব না কিছুই। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে টাকা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু নিরবচ্চিন্ন গ্যাস আমরা পাচ্ছি না। একই অবস্থা বিদ্যুতেরও। এ সময় মজুরি বেড়েছে, ব্যাংক লোন বেড়েছে। সরকার কম করে হলে আমাদের এক্সিট প্ল্যান করে দেন, কারণ এ বছর অনেকেই ব্যবসা ছাড়বে।

সরকার ধনীদের দেখে না, গরীব ব্যবসায়ীদের ধরে

গাজীপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জিএমসিসিআই) সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিদেশ থেকে সোনা যখন আসে তখন সব জায়গায় এক দাম থাকে। কিন্তু ওয়া হওয়ার পর আমাদের দেশে ভরিপ্রতি দাম চলে যায় ১ লাখ টাকার উপরে, যেখানে সিঙ্গাপুরে দাম হয় মাত্র ৮৪ হাজার টাকা। সিঙ্গাপুরে জায়গা ভাড়া, কর্মচারীর বেতন সব আমাদের দেশের থেকে বেশি। তাহলে বাংলাদেশে কীভাবে দাম বেশি হয় সিঙ্গাপুর থেকে। আপনাদের সামনে দিয়েই এগুলো হচ্ছে। কিন্তু আপনারা ধনীদের দিকে দেখেন না, গরীব ব্যবসায়ীদের উপরই আপনাদের যত কড়াকড়ি।

সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি কথা স্বীকার করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, শুল্ক, মূসক ও আয়কর কর্মকর্তাদেরকে কর ফাঁকি বের করতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হয় প্রচুর। এর কারণে অনেক সৎ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা কমানোর জন্য পুরস্কার প্রথা বাতিল করতে হবে। অন্য কোনোভাবে তাদের প্রণোদনা দেবেন- তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

আশ্বাস ছাড়া আর কিছু দিলেন না অর্থমন্ত্রী

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ প্রকাশের পর সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরাবরের মতো আশ্বাসটুকুই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

তিনি বলেন, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আপনাদের সঙ্গে বসছে। সবার বক্তব্য ও প্রস্তাবনা তার কাছে আপনারা দিয়েছেন। আজকে পাবলিক ফোরামেও তা বললেন। আপনাদের বক্তব্য আমরা বিবেচনা করব। দেখি এবারের বাজেটে কতটুকু করা যায়।

বাজেট একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট করতে হয়। আমরাও আমাদের সব অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট করব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা সুস্পষ্ট, যার যতটুকু প্রাপ্য সে ততটুকুই পাবে।

কর ন্যায়পাল নিয়োগের প্রস্তাবটি ভেবে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, সারা বিশ্বের যে অর্থনৈতিক অবস্থা। তার থেকে আমরা বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি। এর জন্য প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা অনেক। প্রাইভেট সেক্টরই আমাদের মূল চালিকা শক্তি।

রপ্তানির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশীয় বাজারে পণ্য বিক্রির দিকে আমাদের মনোযোগ বেশি। কারণ এতে লাভ বেশি থাকে। কিন্তু আমাদের রপ্তানিতে মনোযোগ দিতে হবে। তা নাহলে আপনারা যেই ডলার সংকটের কথা বলছেন, সেই ডলার আসবে কোথা থেকে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত