রাতের অন্ধকারে আলো-ঝলমলে সমুদ্র সৈকত। মরুভূমিতে লাগানো হচ্ছে কোটি কোটি গাছ। যাতায়াতের জন্য থাকবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক লেভিটেশন ট্রেন। আকাশে থাকবে কৃত্রিম চাঁদ। মরুর বুকে ১০০ মাইলের চেয়েও দীর্ঘ সরল রেখায় নির্মিত হবে একটি গাড়ি-মুক্ত ও কার্বন-মুক্ত তথা পরিবেশবান্ধব শহর। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্ননগরী নিওমের জন্য কিছু পরিকল্পনা এসব।
দাবি করা হচ্ছে, নিওম হতে যাচ্ছে “পৃথিবীর স্বাস্থ্য ঠিক রেখে আগামী দিনে মানবজাতির উন্নতির এক নতুন ব্লুপ্রিন্ট”। এর জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলার। তেল নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্র্যময় করার পাশাপাশি একটি সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ এর একটি অংশ এই প্রকল্প।
মোট ২৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শহরটি আকারে কুয়েত বা ইসরায়েলের চেয়েও বড় হবে। শহরটি সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক সৌদি বিচার ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকবে এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত আইনি ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে। আর সেই আইনি ব্যবস্থাটি তৈরি করবেন শহরটিতে বিনিয়োগকারীরা।
‘দ্য লাইন’ নামের শহরটি প্রস্থে ২০০ মিটার আর দৈর্ঘ্যে ১৭০ কিলোমিটার (১০৫মাইল)। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে শহরটির মাত্র ২.৪ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হবে।
পৃথিবীকে জলবায়ু সংকট থেকে বাঁচানোর কথা মাথায় রেখে নকশা করা শহরটির নির্মাণে যুক্ত আছে কয়েক ডজন পশ্চিমা কোম্পানি। কিন্তু এই শহরে জন্য জমি খালি করতে গিয়ে প্রয়োজনে মানুষ মারার আদেশও দিয়েছে সৌদি রাজপরিবার।
কর্নেল রাবিহ আলেনেজি নামে দেশটির এক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ মরুভূমির মাঝখান দিয়ে নির্মিতব্য শহরের জন্য জমি খালি করতে হত্যার অনুমতিও দিয়েছে।
সাবেক ওই সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, নিওম মহাপ্রকল্পের অংশ দ্য লাইন নামের শহরটির জন্য পথ তৈরি করতে তাকে একটি উপজাতি এলাকা থেকে গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ওই উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় উপজাতিটির একজনকে গুলি করে হত্যাও করা হয়।
এ ব্যাপারে বিবিসি যোগাযোগ করলেও সৌদি সরকার এবং নিওম প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। কয়েকটি ব্রিটিশ কোম্পানিও শহরটির নির্মাণকাজে জড়িত আছে।
যে এলাকায় নিওম মহানগরটি নির্মাণ করা হচ্ছে সেটিকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) নিখুঁত ‘ফাঁকা ক্যানভাস’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু তার সরকারের হিসাব মতেই, ৬ হাজারেরও বেশি মানুষকে এই প্রকল্পের জন্য ‘স্থানান্তরিত’ করা হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ এএলকিউএসটি বলছে, এই সংখ্যা আরও বেশি।
আল-খুরায়বাহ, শারমা ও গায়াল নামে তিনটি গ্রামের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসি দেখতে পায়, সেখানে থাকা বাড়িঘর, স্কুল ও হাসপাতালগুলো সব গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত বছর যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া কর্নেল আলেনেজি বলেন, তাকে আল-খুরায়বাহ গ্রামের উচ্ছেদ অভিযানটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গ্রামটি দ্য লাইনের ৪.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে।
গ্রামগুলোতে বেশিরভাগই হুওয়াইতাত উপজাতির মানুষদের বাস ছিল। উপজাতিটির মানুষেরা দেশটির উত্তর-পশ্চিমের তাবুক অঞ্চলে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে।
কর্নেল আলেনেজি বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিলে দেওয়া উচ্ছেদ অভিযানের আদেশনামায় বলা হয়েছিল, হুওয়াইতাত উপজাতির লোকদের মধ্যে অনেক বিদ্রোহী রয়েছে। ফলে যারাই উচ্ছেদ অভিযান প্রতিরোধ করতে আসবে প্রয়োজন হলে তাদের হত্যাও করা উচিৎ। অর্থাৎ, যারা নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে চাইবে না তাদের ওপর প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তিনি নিজের স্বাস্থ্য খারাপ থাকার অজুহাত দেখিয়ে ওই অভিযানে অংশ নেননি। পরে তাকে ছাড়াই অভিযানটি চালানো হয়।
আব্দুল রহিম আল-হুওয়াইতি নামের একজন নিওমের ভূমি রেজিস্ট্রি কমিটির কাছে তার সম্পত্তি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এর একদিন পর উচ্ছেদ অভিযানের সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি এর আগে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় একাধিক ভিডিও পোস্ট করেছিলেন।
সেসময় সৌদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, আল-হুওয়াইতি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি চালালে তারা পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ বলছে, শুধু উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দেওয়ার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
বিবিসি এই প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ সম্পর্কে কর্নেল আলেনেজির মন্তব্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
কিন্তু সৌদি গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র বলেছে, কর্নেল আলেনেজির অভিযোগ সত্য। তারা বলেন, তারা এই ধরনের মিশন সম্পর্কে সাধারণভাবে যা জানেন কর্নেলের দাবি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
জাতিসংঘ ও এএলকিউএসটির তথ্য মতে, উচ্ছেদ অভিযান প্রতিরোধ করার কারণে আরও অন্তত ৪৭ জন গ্রামবাসীকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে বিচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪০ জন কারাগারে আছেন, আর পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সোশাল মিডিয়ায় আল-হুওয়াইতির মৃত্যুতে প্রকাশ্যে শোক প্রকাশ করার কারণেও বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, দ্য লাইনের জন্য যাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এএলকিউএসটির তথ্যমতে, উচ্ছেদকৃতদের প্রতিশ্রুত পরিমাণের চেয়ে অনেক কম অর্থ দেওয়া হয়েছে।
কর্নেল আলেনেজির মতে, “নিওম প্রকল্প মোহাম্মদ বিন সালমানের চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু। আর এজন্যই তিনি হুওয়াইতাত উপজাতির সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এত নৃশংস ছিলেন।”
নিওমের স্কি প্রজেক্টের সাবেক জেষ্ঠ্য নির্বাহী অ্যান্ডি ওয়ার্থ বিবিসিকে বলেছেন, ২০২০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে আব্দুল রহিম আল-হুওয়াইতির হত্যার কথা শুনেছিলেন। তিনি বলেন, তিনি বারবার তার নিয়োগকর্তাদের কাছে ওই উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনও সন্তোষজনক উত্তর পননি।
অ্যান্ডি ওয়ার্থ বলেন, “এই লোকদের ওপর ভয়ানক কিছু করা হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। নিজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যের গলায় পায়ের বুটের হিল দিয়ে চাপা দেওয়া উচিৎ নয়।” নিওম প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় অসন্তুষ্ট হয়ে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি প্রকল্পটি ত্যাগ করেন।
২০২২ সালে দ্য লাইনের ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসে ব্রিটিশ পানি বিশুদ্ধকরণ কোম্পানি সোলার ওয়াটার পিএলসি। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী ম্যালকম অউও প্রকল্পটি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, “সেই এলাকায় বসবাসকারী কিছু উচ্চশ্রেণির মানুষদের জন্য এটি ভালো হতে পারে, কিন্তু বাকিদের কী হবে?”
ম্যালকম বলেন, স্থানীয় জনগণকে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখা উচিৎ। কারণ তারাই তাদের অঞ্চলটিকে সবচেয়ে ভালো বোঝেন। স্থানীয় জনগণকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ না করেই কীভাবে উন্নতি করা যায়, তাদের কাছ থেকেই সেই পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।”
বাস্তুচ্যুত গ্রামবাসীরা ভয়ে এ ব্যাপারে বিবিসির কাছে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাদের আশঙ্কা, বিদেশি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললে তাদের আটক আত্মীয়দের বিপদ আরও বাড়তে পারে।
তবে বিবিসি ভিশন ২০৩০ এর আরেকটি প্রকল্পের জন্য অন্যত্র উচ্ছেদকৃতদের সঙ্গে কথা বলেছে। পশ্চিম সৌদি আরবে জেদ্দা সেন্ট্রাল প্রকল্পের জন্য ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেখানে একটি অপেরা হাউস, স্পোর্টিং ডিস্ট্রিক্ট এবং বিলাসবহুল শপিং মল ও আবাসিক ভবন তৈরি করা হচ্ছে।
সেখানে প্রায় ৬৩টি আবাসিক এলাকা থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়, এর মধ্যে একটি এলাকার নাম আজিজিয়া। সেখানকার বাসিন্দা নাদের হিজাজি (ছদ্মনাম) জানান, তার বাবার বাড়িটি ২০২১ সালে গুড়িয়ে দেওয়া হয়, যার জন্য তাদের মাত্র এক মাসেরও কম সময় আগে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
হিজাজি বলেন, তাদের এলাকার বাড়িঘরগুলো গুড়িয়ে দেওয়ার পর এর দৃশ্য দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, সরকার যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে।
“তারা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, আমাদের পরিচয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।”
সৌদি অ্যাক্টিভিস্টরা বিবিসিকে গত বছর জেদ্দা ধ্বংসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া দুজন ব্যক্তির কথা বলেছিল। একজনকে উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দেওয়ার জন্য আর অন্যজনকে সামাজিক মিডিয়ায় ধ্বংস বিরোধী গ্রাফিতির ছবি পোস্ট করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।
জেদ্দার ধাহবান কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন বন্দীর আত্মীয়রা বলেছেন, তারা সেখানে আরও ১৫ জনকে বন্দী করার খবর শুনেছেন। মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া নিজেদের আবাসিক এলাকাকে শেষ বিদায় জানাতে জড়ো হওয়ার কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সৌদি কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় বিবিসি বিষয়টি যাচাই করতে পারেনি।
এএলকিউএসটি জেদ্দার আশেপাশের এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ৩৫ জনের উপর জরিপ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ বলেননি যে, তারা স্থানীয় আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বা পর্যাপ্ত সতর্কতা পেয়েছেন। অর্ধেকেরও বেশি বলেছেন, গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে তাদেরকে তাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
কর্নেল আলেনেজি এখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারপরও তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বলেন, একজন সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে বলেছিলেন, তিনি যদি সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনের সৌদি দূতাবাসে একটি বৈঠকে যোগ দেন, তবে তাকে ৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
বিবিসি সৌদি সরকারের সঙ্গে এই অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি।
বিদেশে বসবাসকারী সৌদি সরকারের সমালোচকদের উপর গোপনে হামলা নজিরবিহীন নয়। এমন হামলার সবচেয়ে বড় ঘটনা হল সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহাম্মদ বিন সালমানই খাশোগিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ওই হত্যাকাণ্ডে নিজের কোনও ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন।
কর্নেল আলেনেজি জানান, সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ শহর সম্পর্কিত আদেশ অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মধ্যে কোনও অনুশোচনা নেই।
তিনি বলেন, “আমি বুঝে গিয়েছিলাম, মোহাম্মদ বিন সালমান নিওম নির্মাণের পথে কোনও কিছুকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবেন না। ফলে নিজের লোকদের জন্য আমাকে আরও কী কী করতে বলা হতে পারে, তা নিয়ে আমি অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি