নেপালের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কারও প্রথম সফর হয় কোন দেশে? এর কোনও নিয়ম নেই; কিন্তু ইতিহাস দেখলে উত্তর আসবে- ভারত। সেই প্রথা ভেঙে দিলেন কে পি শর্মা ওলি। এই দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে দ্বিপক্ষীয় প্রথম সফরে চীন ঘুরে এলেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (সংযুক্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নেতা ওলি গত ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এটা তার প্রথম নয়, এর আগে তিন দফায় ভারতের প্রতিবেশী দেশটির সরকার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
চতুর্থ দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল তার। তখন মোদীকে তিনি নেপাল সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন।
কিন্তু কমিউনিস্ট নেতা ওলি ভারত সফরের আনুষ্ঠানিক কোনও আমন্ত্রণ পাননি বলেই খবর দিয়েছে ফরেইন পলিসি; যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকীটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওলির প্রতি দিল্লির মনোভাব আসলে কেমন, এর মধ্যদিয়ে হয়ত তার প্রকাশ ঘটেছে। কারণ তাকে চীনঘেঁষা হিসাবে দেখে আসছে ভারতীয় কর্মকর্তারা।
তাই ওলি প্রথম সফরে গেলেন ভারতের বৈরী প্রতিবেশী দেশ চীনে; আর তা যে নয়া দিল্লি উদ্বেগের দৃষ্টিতে দেখবে, সেকথা ফরেইন পলিসি আগেই লিখেছিল। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওলির চীন সফর অবশ্যই নয়া দিল্লির জন্য কিছুটা উদ্বেগের।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় চীনের সঙ্গে অংশীদারি চুক্তি, যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে নয়া দিল্লিকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন ওলি।
তার মধ্যেই নতুন করে দায়িত্ব নিয়ে চার দিনের সফরে চীন যান ওলি; সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র আওতায় একটি কাঠামো চুক্তি করেন; অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন। সফর শেষ করে বৃহস্পতিবারই কাঠমান্ডুতে ফিরেছেন ওলি।
তার এই সফর যে ভারত ভালো চোখে দেখছে না তা সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিন অধ্যাপক শ্রীকান্ত কোণ্ডাপাল্লি হংকংয়ের সংবাদপত্রটিকে বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে থেকে দুই দেশের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে এখন নেপাল। কারও প্রতি বেশি ঝুঁকে থাকা এড়াতে চাইছে।
“এই সফর ইঙ্গিত দিচ্ছে, নেপাল ভারতের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক চায়। কিন্তু তা করার মতো সক্ষমতা তার আসলে বেশ কম।”
নেপালে ওলি একটি জোট সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে তাকে জোটের অন্য দলগুলোকে সমঝেই চলতে হয়।
ভারেতের রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্লেষক অমিশ রাজ মুলানি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেন, ওলির জোট নেপালের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে ভালোভাবেই এগোচ্ছে।
“আমি মনে করি, ভারত ও নেপালের কূটনীতি বেশ পরিণত, ফলে ভিন্ন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে উভয়েরই নজর থাকবে, যাতে নিজেদের আন্তঃসম্পর্ক যেন ক্ষুণ্ন না হয়।”
চীন থেকে কী পেলেন ওলি?
ওলির এই সফর শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, নেপালের অর্থনৈতিক কারণেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নেপাল এখন অর্থ সংকটে রয়েছে।
এই অবস্থায় চীনের ঋণ নেওয়া নিয়েও ওলির জোট সরকারে দ্বন্দ্ব রয়েছে। জোটভুক্ত নেপালি কংগ্রেস পার্টি চীন থেকে ঋণ নেওয়ার বিরোধী; তারা চায় চীনের অনুদান।
অন্যদিকে ওলির কমিউনিস্ট পার্টির মত, এখন অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি, সেজন্য ঋণ নেওয়াতেও কোনও আপত্তি থাকা উচিৎ নয়।
সফরে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র আওতায় কাঠামো চুক্তিটি মঙ্গলবার সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দর কষাকষিতে তা একদিন পিছিয়ে গিয়েছিল বলে কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে।
চুক্তিপত্রে চীনের খসড়ায় ছিল লোন (ঋণ), অন্যদিকে নেপালের প্রতিনিধিদের দাবি ছিল, সেখানে গ্রান্ট (অনুদান) লিখতে হবে। শেষে এইড (সহায়তা) লিখতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। অমিশ রাজ মুলানি বলেন, এতে দুই পক্ষেরই জয় হয়েছে।
চীন এর আগে নেপালকে প্রায় ২২ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। সেই ঋণ দেওয়া হয় পোখারায় একটি বিমানবন্দর নির্মাণে, যেটি গত বছর চালু হয়েছে।
চীনের কাছ থেকে এবার ৪ কোটি ১০ লাখ ডলার নগদ সহায়তার একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন ওলি। তবে নেপাল বিমানবন্দরের ঋণের ক্ষেত্রে কিছু সৃুদছাড় চাইছিল, সে বিষয়ে কোনও ঘোষণা আসেনি।
কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, ওলির এই সফরে নেপালে তোখা-চাহারে টানেল রোড নির্মাণে চীনের বিনিয়োগ এবং দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ানো নিয়েও সমঝোতা চুক্তি সই হয়।
দুই দেশের মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়, যার আওতায় নেপাল গরুর মাংস রপ্তানি করবে চীনে। এছাড়া পর্যটনের প্রসার ও শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু বিষয়েও সমঝোতা স্মারক সই করে দুই দেশ।