দক্ষিণ লেবাননে হামলা হামলা বন্ধ করছে না ইসরায়েল; উল্টো ওই এলাকা থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদেরই সরিয়ে নিতে বললেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলি হামলায় দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘের পাঁচজন শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে আহতও হয়েছে। ‘ইউনিফিল’ নামে এই মিশনে ৫০টি দেশের ১০ হাজার শান্তিরক্ষী রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে ১২০ জন।
১৯৭৮ সালে ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননে অভিযান চালানোর পর শান্তি রক্ষায় ‘ইউনাইটেড নেশনস ইনটেরিম ফোর্স ইন লেবানন (ইউনিফিল)’ কাজ করে আসছে। দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েল সীমান্তবর্তী এলাকায় আন্তর্জাতিক এই বাহিনীর অবস্থান।
শান্তিরক্ষীরা আক্রান্ত
গাজা যুদ্ধ শুরুর এক বছর পর দক্ষিণ লেবাননে শিয়া মিলিশিয়া দল হিজবুল্লাহর ওপর এখন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেই হামলায় সম্প্রতি অন্তত পাঁচজন শান্তিরক্ষী আহত হয়।
গত রবিবার দুই শান্তি রক্ষী আহত হওয়ার পর জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ট্যাংক থেকে নাকুরায় সরাসরি ইউনিফিলের একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে গোলা বর্ষণ হয়।
ওই এলাকায় অবিযান চালানোর কথা স্বীকার করেছে ইসরায়েল। তবে তাদের দাবি, সেখানে হিজবুল্লাহ ঘাঁটি গেঁেড়েছে। তাদের লক্ষ্য করে হামলা হচ্ছে।
এই অভিযানের মধ্যে আরও তিনজন শান্তিরক্ষী আহত হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ এখন ইসরায়েল। তাকে সম্প্রতি ইসরায়েলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তেল আবিব সরকার।
নেতানিয়াহুর হুমকি
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা আহত হওয়ার পর সমালোচনায় পড়ে ইসরায়েল সরকার। তবে তা আমলেই নিচ্ছে না দেশটির সরকার।
নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় গুতেরেসকে উদ্দেশ করে বলেছেন, “মহাসচিব, ইউনিফিল বাহিনীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন। আর এটা করতে হবে এখনই।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এর আগেও সীমান্ত এলাকা থেকে শান্তিরক্ষীদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে জাতিসংঘ তা প্রত্যাখ্যান করে।
নেতানিয়াহু বলেন, তেল আবিবের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে হিজবুল্লাহ সন্ত্রাসীদের ‘ঢাল’ হিসাবে কাজ করানো হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের।
“শান্তিরক্ষীরা যাতে আহত না হয়, তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করছি। কিন্তু তাদের সরিয়ে না নিয়ে আপনারা (জাতিসংঘ) শান্তিরক্ষীদের হিজবুল্লাহর কাছে জিম্মি করে রাখছেন। তাদের সুরক্ষার সহজ পথ হচ্ছে বিপজ্জনক ওই এলাকা থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়া।”
নেতানিয়াহুর এই হুমকির নিন্দা জানিয়েছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি। তিনি বলেছেন, নেতানিয়াহু আসলে জাতিসংঘ বাহিনীর বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন। এটা আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন।
ইউনিফিলে আছে কোন কোন দেশের সেনা
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে লেবাননে ইসরায়েলের অভিযান শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইউনিফিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন লেবানন থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল, ওই অধিবেশনেই ইউনিফিল গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন পায়।
ওই সিদ্ধান্তের আলোকে তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইউনিফিল গঠিত হয়। প্রথমত, লেবানন থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার; দ্বিতীয়ত, সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা; তৃতীয়ত, ওই এলাকায় লেবাননের সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
ইউনিফিলের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, সেখানে সবচেয়ে বেশি সৈন্য রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার, ১২৩১ জন। সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ইতালি (১০৬৮ জন)। তৃতীয় স্থানে থাকা ভারতের সৈন্য সংখ্যা ৯০৭, এরপরের অবস্থানে নেপাল (৮৭৬ সেনা)।
বাংলাদেশের ১২০ জন সেনা ছাড়াও অন্য দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার ১২৬ জন, জার্মানির ১১২ জন, স্পেনের ৬৭৬ জন, ফ্রান্সের ৬৭৩ জন, চীনের ৪১৮ জন, কোরিয়ার ২৯৪ জন সৈন্য রয়েছে সেখানে।
যুক্তরাজ্যসহ ১৩টি দেশের সৈন্য রয়েছে একজন করে।
তবে এই সেনারা সেখানে কোনও যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, তাদের কাজ হচ্ছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, বেসসামরিক মানুষকে রক্ষা করা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনঃস্থাপন করা।
যদিও এখন তারা যুদ্ধের মধ্যে পড়েছে।
কোথায় আছে শান্তিরক্ষীরা
মূলত দক্ষিণ লেবাননেই ইউনিফিলের কাজ। কারণ ইসরায়েলি বাহিনী ১৯৭৮ সালে ওই সীমান্ত দিয়েই ঢুকেছিল। তবে এখন ওই এলাকায় এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে হিজবুল্লাহ।
ইউনিফিলের কার্যক্রম এখন লিটানি নদী থেকে ব্লু লাইন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে। ৫০টি স্থানে অবস্থান রয়েছে শান্তিরক্ষীদের। এর সদর দপ্তর লেবাননের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নাকুরায়।
ব্লু লাইন হচ্ছে ২০০০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত রেখা। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্ত।
জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সীমান্তে ইসরায়েল কিংবা লেবাননের কোনও ধরনের কার্যক্রম চালাতে গেলে ইউনিফিলকে আগেই জানাতে হয়।
ইউনিফিলের কার্যক্রম চলার মধ্যেও অবশ্য সেখানে যুদ্ধ থামানো যায়নি। ১৯৮২ সালেও একবার ইসরায়েল লেবাননের ভেতরে অভিযান চালিয়েছিল। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল তখন দখল করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেই দখলদারত্ব ছিল।
হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে ২০০৬ সালে আবার ইসরায়েলি বাহিনী ঢুকে পড়েছিল লেবাননের ওই অঞ্চলে। সেবার এক মাস ছিল ইসরায়েলের দখলদারত্ব।
ওই সীমান্তে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর দ্বন্দ্ব অবসানে এই বছরের আগস্টে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ওই প্রস্তাবে সীমান্তের নিরপেক্ষ এলাকায় যুদ্ধবিরতির আশা জাগালেও এখন সেখানে যুদ্ধই শুরু হয়ে গেছে।