বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের কাহিনি লিখেছিলেন কলম্বীয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। বিশ শতকের সেরা সাহিত্য বলে গণ্য হওয়া ‘সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ’ অর্থাৎ ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ উপন্যাসটির লেখক ১৯৬৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া এবং স্ত্রী উরসুলা ইগুয়ারান দিয়ে এই কাহিনির শুরু। বুয়েন্দিয়া পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করে মাকোন্দো গ্রামে।
লাতিন আমেরিকার এই গ্রামটিকে যুগের পর যুগ ধরে জানে পাঠকেরা। অথচ কল্পনায় ছাড়া এই গ্রামের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। কিন্তু এবার কল্পনা পেরিয়ে সেই গ্রামের বাস্তব অবয়ব দেখা গেল নেটফ্লিক্সের স্ক্রিনে।
এক রৌদ্রজ্বল দিনে ছোপ ছোপ রক্ত মাখা সাদা প্লাস্টার করা দেয়ালের দিকে পিঠ রেখে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা দর্শকরা চলে যান নদী পাড়ের বিচ্ছিন্ন মাকোন্দো জনপদে; যা যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শোষণে পিষ্ট হওয়ার আগে ছিল সমৃদ্ধ এক নগর।
জাদুবাস্তবতা ভরা এই উপন্যাসে অতিপ্রাকৃত ও স্বপ্নময় ঘটনায় মাখামাখি আছে সাবলীল ভাবে; যেন এসব প্রতিদিনের ঘটনা। যেমন গ্রামের বাসিন্দাদের দেখা দিল অনিদ্রা মহামারী। আর তাতে স্মৃতি বিস্মৃত হতো সবাই।
লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জন্মস্থান কলম্বিয়াতেই পুরোপুরি চিত্রায়িত হয়েছে এই নেটফ্লিক্স সিরিজের দুই মৌসুম। আর এখানেই বাস্তব হয়ে উঠেছে মাকোন্দো গ্রাম।
নিজের গল্প বলার জাদুকরী ক্ষমতার পুরো কৃত্বিত্ব দাদিকে দিয়েছিলেন মার্কেজ। এই কথাসাহিত্যিকের কাছে মনে হতো, তার দাদি সাবলীল ভাবে দারুণ সব বিষয়ে কথা বলতে পারতেন।
“সবচেয়ে দেখার মতো ছিল তার মুখের অভিব্যক্তি”; ১৯৮১ সালে দ্য প্যারিস রিভিউ ম্যাগাজিনে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছিলেন মার্কেজ।
উপন্যাস লেখার পেছনের কথা জানিয়ে মার্কেজ বলেন, “আমি নিজেই নিজের গল্পে ততটা বিহ্বল না হওয়ার পরও গল্পটি লিখতে চেয়েছিলাম।
“তারপর আমি উপলব্ধি করি, আগে আমার নিজের কাছে গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। এরপর আমার দাদি যেমন করে কথা বলেন তেমন ভঙ্গিতে গল্পটা লিখতে হবে। দাদি একে বলতেন, চেহারায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলা।”
মাকোন্দো গ্রামের পটভূমি
মানচিত্রে মাকোন্দো গ্রামের কোনোই অস্তিত্ব নেই। ২০০৬ সালে মার্কেজের জন্মস্থান আরাকাটাকার নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব সফল হলে হয়তো সে সম্ভাবনা ছিল। শেষ পর্যন্ত এই গ্রাম দশকের পর দশক ধরে পাঠকের মনেই জীবন্ত হয়ে আছে।
কলম্বিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে এই গ্রামের সম্পর্ক আছে বলে ১১ ডিসেম্বর থেকে নেটফ্লিক্সে শুরু হওয়া এই সিরিজটি সেখানেই ধারণ করা হয়েছে পুরোপুরি স্প্যানিশ ভাষায়।
সিরিজ নির্মাণে মার্কেজের পরিবারের সম্মতি নেয়া হয়েছিল। লেখকের ছেলে রড্রিগো গার্সিয়া এবং গঞ্জালো গার্সিয়া নির্বাহী প্রযোজকের কাজও করেছেন।
কলম্বিয়ার ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়কে ঘিরে চলেছিল ’ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’ উপন্যাসের কাহিনি; এক ভিডিও কলে এই তথ্যটি সিএনএনকে দিলেন প্রডাকশন ডিজাইনার বারবারা এনরিকেজ।
“আমরাও তাই সিরিজে গল্পটিকে কালের সাক্ষী হিসাবে দেখেছি।”
‘পনস ল্যাবিরিন্থ’ সিনেমার সেটের জন্য অস্কার পাওয়া মেক্সিকান প্রোডাকশন ডিজাইনার ইউজেনিও ক্যাবালেরো প্রকল্পটি থেকে সরে গেলে এনরিকেজ ২০২২ সালে প্রোডাকশন ডিজাইনের দায়িত্ব নেন। । তারা দুজনে ২০১৮ সালে আলফোনসো কুয়ারন পরিচালিত একাডেমি অস্কারজয়ী ’রোমা’ সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছিলেন।
নেটফ্লিক্সের দাবি, উপন্যাস থেকে নির্মিত এই সিরিজটি লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন; যেখানে তিনটি আলাদা আলাদা নগর গড়ে তোলা হয়েছে।
মাটির কুঁড়েঘর ও বাঁশ দিয়ে বানানো গ্রামে চাচাতো ভাই-বোন হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া ও উরসুলা ইগুয়ারান বড় হয়ে ওঠে; একে অপরকে বিয়ে করে। এক পর্যায়ে তারা গ্রামবাসীর এক অংশকে নিয়ে পর্বতমালা ও জলাভূমি পেরিয়ে মাকোন্দো অভিযানে নিয়ে যায়।
মাকোন্দো গ্রামের দুটি সংস্করণ ছিল: শুরুর দিকে সাধারণ খড়ের বাড়ি ও মাটির রাস্তা; এরপর বাইরের জগতের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়ে হয় সবুজ রাস্তা এবং আধুনিক বহুতল বাড়ি।
“জাদুবাস্তব হলো এমন এক বাস্তবতা যেখানে মায়াজাল ছড়িয়ে আছে। সেট ডিজাইন করতে গিয়ে আমরা ঠিক করেছিলাম ঐতিহাসিক পটভূমি ধরে রাখা হবে,” বললেন এনরিকেজ।
এতে অনেক জিনিসের বিস্ময়কর দিক দেখানোতে কোনো অসুবিধা হয়নি। যেমন জিপসি চরিত্র মেলকিউয়াদেস পুরো মাকোন্দোর ইতিহাস লিখছিলেন চামড়ার কাগজে; আর এই লেখাই হয়ে ওঠে পুরো গল্প। এসব দৃশ্যায়ন ফুটিয়ে তুলতে একজন সংস্কৃত অনুবাদকের সহায়তা নেয়া হয়; যিনি পুরো লেখা ও ক্যালিওগ্রাফির কাজ করেছিলেন।
মাকোন্দোতে প্রথম বরফের টুকরা নিয়ে আসে একদল জিপসি। আউরেলিয়ানোর স্মৃতিতে এই ঘটনা আজীবন রয়ে যায়। একটি সোনালী বাক্সে ঝলমলে হিরার মতো দেখা যায় ওই বরফের টুকরাটিকে। বাক্স খুললে কুয়াশার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া এবং তার দুই ছেলের মুখে। এই বরফটি কিন্তু আসল ছিল।
“অভিনয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে তা জরুরি ছিল। যখন তরুণ আউরেলিয়ানো এই বরফ স্পর্শ দেখবে তার অভিনয়ে সত্যিকারের অনুভূতিই জেগে উঠবে।”
একটি বাড়ি যেভাবে চরিত্র হয়ে ওঠে
নগরের উল্লেখযোগ্য অংশে দাঁড়িয়ে আছে বুয়েন্দিয়া পরিবারের বাড়িটি। পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন অনুসারে এর বিস্তার হতে থাকে। এখানে শোবার ঘরে দেখা মেলে প্রেমে ব্যর্থ চরিত্রের; যারা মশারির ভিতরে ঘনিষ্টতা খুঁজে পায়। এখানে কেমিস্ট্রি ল্যাবে হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া ও মেলকিয়াদেসের অনুসন্ধানী পরীক্ষা চলে। আউরেলিয়ানোর কারখানায় বানানো হয় সোনার মাছ; যা এই সিরিজের জন্য বিশেষ ভাবেই করা হয়েছিল। আমারান্ত ও রেবেকা বড় হয়ে উঠলে বুয়েন্দিয়া পরিবারে আসে সংগীত; ইতালীয় পিয়েত্রো ক্রেসপি নিয়ে আসে একটি পিয়ানো আর মিউজিক বাক্স; যা বিশেষ ভাবে সিরিজের জন্য বানানো হয়।
এনরিকেজ বলেন, “এই বাড়িটি যেন বুয়েন্দিয়ার প্রতিচ্ছবি; যা ক্ষণে ক্ষণে নানা রূপে ধরা দেয়।
“যখন উরসুলা খুশি থাকে, বাড়িও আনন্দে থাকে। আবার উরসুলার মন খারাপ হলে বাড়িতেও নেমে আসে বিষণ্ণতা। আর গোটা শহর যুদ্ধে গেলে, এই বাড়িও যুদ্ধে যোগ দেয়।”
আলোয় মাখামাখি, বাতাসের আনাগোনা ভরা এই বাড়িটি সাজাতে এনরিকেজের দল প্রাচীন আসবাবের বিশাল সংগ্রহ খুঁজে বের করেছিল। প্রযোজকরা কলম্বিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। কর্দোবার জেনু সম্প্রদায়ের কারিগরেরা ঝুড়ি বুনে দিয়েছিল। ম্যাগদালেনার চিমিলা জনগোষ্ঠী স্থানীয় ’চিনচোরো’ অর্থ্যাৎ হামক বানিয়ে দিয়েছিল।
“আমরা এমন সব জিনিস ও উপকরণ নিয়ে এসেছিলাম যা ঐতিহাসিক কাল এবং আদিবাসীদের সঙ্গে মানানসই ছিল। আমরা দেশের অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে সেই সব কারিগরদের খুঁজে পেয়েছি, যারা এসবের ব্যবহার করতে জানতেন।”
এনরিকেজের মতোই পোশাক ডিজাইনার ক্যাথরিন রড্রিগেজেরও ছিল মাকোন্দোকে কল্পনা করার বিশেষ ধরণ।কলম্বিয়ার জাতীয় তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। ওই সময়ের জলরঙ আঁকার ছবির ধরণ নিয়েও কাজ করেন তিনি।
“আমি অনেক বই পড়েছি এই লেখক, ওই যুগ এবং ওই সময়ের সাজপোশাক নিয়ে”, সিএনএনকে বললেন ক্যাথরিন।
“অনেক রকম তথ্যই আছে। ওই যুগ নিয়ে জানতে বহু দলিল মিলবে।”
এতোসব গবেষণা ক্যাথরিনের পুরো দলকে অনেক গভীরে নিয়ে গিয়েছিল।
“তখন এমন এক মুহূর্ত আসে যখন স্থির হয়ে বসে নিজেকে সব কিছু গড়ে নিতে হয়। এখানেই আসে সৃজনশীলতার কথা। রং, নকশা, গড়ন বাছাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ কেউ নেই যে বলে দেবে উনিশ বা বিশ শতকে মাকোন্দো দেখতে কেমন ছিল।”
ব্যাখ্যা করে ক্যাথরিন বলেন, ”এখানে আসলে অনেক উপকরণের সমন্বয় আছে। আর পরিচালকের চাওয়া ছিল সবকিছুই যেন সাবলীল দেখায়। কারণ উপন্যাসে তো জাদুবাস্তবের ছড়াছড়ি।”
সময়ের রূপান্তর
সিরিজের কয়েকটি পর্বে মাকোন্দোর বাসিন্দাদের মাটি রঙের কাপড়, চামড়ার বুচ এবং খড়ের টুপি পরতে দেখা যায়। এরপর দেখা যায় ফুলেল গাউন থেকে সেলাই করা স্যুট। নতুন নতুন ফ্যাশন যুক্ত হতে থাকে। জিপসিদের দেখা যায় রঙিন কাপড়ে। পিয়েত্রো ক্রেসপি চরিত্রের পরনে দেখা যায় ইতালির এমব্রয়ডারি করা রেশমি পোশাক। ধনী বিচারপতি পরিবারের জন্য দেয়া হয় ফুল বসানো রোদ টুপি।
উরসুলার পোশাক নিয়ে আলাপে জানা যায়, এতে আমেরিকার গৃহযুদ্ধকালের প্রভাব দেখা যায়।
আলাদা করার মতো বিশেষ প্রিয় চরিত্র নেই বলে সিএনএনকে জানালেন রড্রিগেজ; যদিও রেবেকা ও আমারান্তার বড় হওয়া এবং প্রেম নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রতিটি ধাপে তাদের পোশাকের কাজ করতে বিশেষ ভালো লেগেছে বলেও জানালেন। মেয়ে শিশুদের সাদা গাউন থেকে ধীরে ধীরে এই দুই চরিত্রের পোশাকে আসে রঙ ও নকশার ছোঁয়া।
“তাদের এক সঙ্গে বড় হলেও আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে। তাদের ব্যক্তিত্ব অনুসারে রঙেরও পরিবর্তন ঘটে জীবনে।”
দুই সিজন জুড়ে সময়ের সঙ্গে চলে মাকোন্দো এবং বুয়েন্দিয়া পরিবারের বাড়িটির পরিবর্তন দেখা যায়। এমন বড় একটি প্রকল্পে কাজ করতে শুরুতে ভয় কাজ করছিল বলে জানালেন এনরিকেজ।
এখন অবশ্য পেছন ফিরে দেখে সবার কাজের ফলাফল দেখে তিনি ‘গর্বিত ও সন্তুষ্ট বোধ করেন’।
“আমরা আশা করছি, এর মধ্যে দিয়ে বইমুখী হবে অনেকে, যাদের উপন্যাসটি পড়া ছিল না। অনেকে আবার নতুন করে পড়তে উৎসাহিত হতে পারে।”
এনরিকেজ নিজে কতবার এই উপন্যাসটি পড়েছেন?
হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “দশবার।”