শেখ হাসিনার বিদায়ী সরকারে সিলেটের ছিলেন পাঁচজন, এদের চারজনই ছিলেন পূর্ণমন্ত্রী। এবার সেখানে একজন পূর্ণ মন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রী। রংপুর জেলার এবার কেউ মন্ত্রিত্ব পায়নি।
বরাবরের মতোই মন্ত্রিসভায় রয়েছে ঢাকা অঞ্চলের প্রাধান্য। এবার ঢাকা জেলা থেকে পাঁচজন মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। গাজীপুর জেলা থেকেও স্থান পেয়েছেন তিনজন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এরই মধ্যে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ জন মন্ত্রী, ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার তারা শপথ নেবেন বঙ্গভবনে।
বাংলাদেশে সাধারণত মন্ত্রিসভা গঠনের সময় দক্ষতার পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা চালান সরকার প্রধানরা।
এবারের মন্ত্রিসভা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগ থেকে সবচেয়ে বেশি ১৪ জন মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন আটজন।
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে ২ জন করে মন্ত্রিসভায় এসেছেন।
নির্বাচিতদের বাইরে টেকনোক্র্যাট হিসেবে মন্ত্রিসভায় আসা সামন্ত লাল সেনের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায়। আর ইয়াফেস ওসমানের জন্ম চট্টগ্রামে। তার বাবা কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের বাড়ি অবিভক্ত ভারতের হুগলীতে হলেও তিনি পরে ঢাকায় আবাস গড়েন।
ভোটে ঢাকা জেলা থেকে নির্বাচিত হওয়া ৫ মন্ত্রী হলেন- আসাদুজ্জামান খান কামাল (ঢাকা-১২), সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা-৯), জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা-১৩), নসরুল হামিদ (ঢাকা-৩), মোহাম্মদ আলী আরাফাত (ঢাকা-১৭)।
এদের মধ্যে কামাল, নসরুল আগের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সাবের হোসেন ১৯৯৬ সালের সরকারে উপমন্ত্রী ছিলেন, নানক ছিলেন ২০০৯ সালের সরকারে প্রতিমন্ত্রী। চিত্রনায়ক আকবর পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে উপনির্বাচনে বিজয়ী আরাফাত এবার ভোটে জিতে প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন।
গাজীপুর জেলা থেকে এবার তিনজন মন্ত্রী হচ্ছেন। এর মধ্যে আ ক ম, মোজাম্মেল হক (গাজীপুর-১) গতবারও মন্ত্রী ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী হয়ে নতুন আসছেন সিমিন হোসেন রিমি (গাজীপুর-৪) ও রুমানা আলী (গাজীপুর-৩)।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ে রিমি এর আগে তিন বার এমপি হলেও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর মেয়ে রুমানা এবারই প্রথম সংসদ সদস্য হলেন। গাজীপুরের গতবারের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবার বাদ পড়েছেন।
বৃহত্তর ঢাকা জেলার নরসিংদীর নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন গতবারের মতো এবারও মন্ত্রী হিসেবে থাকছেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে গতবার একমাত্র মন্ত্রী ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী, এবার তিনি মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। গত মন্ত্রিসভায় মানিকগঞ্জের জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। এবার সেই জেলা থেকে কেউ নেই।
কিশোরগঞ্জ থেকে এবার মন্ত্রিসভায় এসেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল হাসান। গত মন্ত্রিসভায় এই জেলা থেকে কেউ ছিল না।
ঢাকা বিভাগে মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল থেকে এবার মন্ত্রিসভায় কাউকে রাখা হয়নি। গতবার টাঙ্গাইল থেকে মন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। এবার বাদ পড়েছেন তিনি। তবে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত আহসানুল ইসলাম টিটু প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন।
বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে এবার পূর্ণ মন্ত্রী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান (গোপালগঞ্জ-১) এবং আবদুর রহমান (ফরিদপুর-১)। প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন রাজবাড়ীর জিল্লুল হাকিম।
এই অঞ্চল থেকে বাদ পড়েছেন গতবারের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। তিনি এবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শরীয়তপুর ও মাদারীপুর থেকে কেউ নেই এবারের মন্ত্রিসভায়।
বৃহত্তর সিলেটে গতবার পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন এ কে এ মোমেন (পররাষ্ট্র), এম এ মান্নান (পরিকল্পনা), শাহাবউদ্দিন (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন) ও ইমরান আহমেদ (প্রবাসী কল্যাণ)। তাদের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মাহবুব আলী।
তারা পাঁচজনই এবার বাদ পড়েছেন, মাহবুব আলী ভোটেও হেরেছেন।
সিলেট থেকে এবার মন্ত্রী হচ্ছেন আব্দুস শহীদ। প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভীবাজার-৪ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
সেখানে এবার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শফিকুর রহমান চৌধুরী শুধু সিলেট জেলার। এই জেলা থেকে আর কেউ নেই। হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ থেকেও কেউ নেই মন্ত্রিসভায়।
রংপুর জেলা থেকে গতবার মন্ত্রী ছিলেন টিপু মুনশি। তিনি বাদ পড়ায় এবার রংপুর জেলা থেকে কেউ নেই।
বৃহত্তর রংপুরের লালমনিরহাট থেকে নূরুজ্জামান আহমেদ গতবার মন্ত্রী ছিলেন, কুড়িগ্রামের জাকির হোসেন ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। দুজনে বাদ পড়ায় এবার জেলা দুটি মন্ত্রীশূন্য।
এই অঞ্চলের দিনাজপুর জেলা থেকে দুজন মন্ত্রিসভায় থাকছেন। তাদের মধ্যে এ এইচ মাহমুদ আলী পূর্ণ মন্ত্রী এবং খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রতিমন্ত্রী।
খালিদ গতবারও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, মাহমুদ আলী ২০১৪ সালের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
পঞ্চগড়ের নুরুল ইসলাম সুজন গতবার মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এবার তিনি বাদ পড়ায় এই জেলা মন্ত্রিশূন্য। নীলফামারী থেকেও এই দফায় কেউ ঠাঁই পায়নি মন্ত্রিসভায়।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা থেকে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা। গতবার মন্ত্রী ছিলেন বান্দরবানের বীর বাহাদুর উ শৈ সিং।
চট্টগ্রাম জেলা থেকে এবার পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিনের ছেলে গতবার ছিলেন উপমন্ত্রী।
চট্টগ্রাম থেকে হাছান মাহমুদ গতবারের মতোই মন্ত্রী থাকছেন। তবে গতবারের মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবার বাদ পড়েছেন।
কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর থেকে এবার কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পায়নি। নোয়াখালী থেকে আগের মতোই মন্ত্রী থাকছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চাঁদপুর থেকে দীপু মনিও থাকছেন এবারের মন্ত্রিসভায়।
কুমিল্লার আ হ ম মুস্তফা কামাল এবার বাদ পড়লেও মন্ত্রী থাকছেন তাজুল ইসলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনিসুল হকের সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছেন র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
রাজশাহীর ৬ জেলায় কেউ মন্ত্রিত্ব পায়নি। জেলাগুলো হচ্ছে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
নওগাঁর সাধন মজুমদার গতবারের মতোই মন্ত্রী থাকছেন। নাটোরের জুনাইদ আহমেদ পলকও থাকছেন প্রতিমন্ত্রী।
খুলনা বিভাগে ৮ জেলার কেউ মন্ত্রী হয়নি। জেলাগুলো হচ্ছে- যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, বাগেরহাট ও ঝিনাইদহ।
গোটা খুলনা অঞ্চল থেকে মন্ত্রিসভায় থাকছেন শুধু নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (খুলনা-৫) এবং ফরহাদ হোসেন (মেহেরপুর-১)। ফরহাদ বিদায়ী সরকারে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, নারায়ণ চন্দ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তার আগের সরকারে।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা থেকে কেউ মন্ত্রিত্ব পায়নি। বরিশাল থেকে জাহিদ ফারুক আগের মতোই প্রতিমন্ত্রী থাকছেন, তার সঙ্গে এবার প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন পটুয়াখালীর মহিববুর রহমান।
পিরোজপুরের শ ম রেজাউল করিম গতবার মন্ত্রী থাকলেও এবার বাদ পড়েছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর থেকে এবারও মন্ত্রিসভায় রয়েছেন ফরিদুল হক খান। গতবার তার সঙ্গে থাকা কে এম খালিদ, শরীফ আহমেদ এবার বাদ পড়েছেন। ময়মনসিংহ থেকে এবার মন্ত্রী হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম।
নেত্রকোনা থেকে মন্ত্রিসভায় থাকা আশরাফ আলী খান খসরুর সঙ্গে টেকনোক্র্যাট কোটায় থাকা মোস্তাফা জব্বারও এবার বাদ পড়েছেন। ফলে নেত্রকোনার কেউ নেই এবারের মন্ত্রিসভায়।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, নোয়াখালী, নরসিংদী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নওগাঁ, ফরিদপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, মেহেরপুর, জামালপুর, রাজবাড়ি, কিশোরগঞ্জ, নাটোর, পটুয়াখালী, বরিশাল, খাগড়াছড়ি, সিলেট, টাঙ্গাইল থেকে একজন করে মন্ত্রী হচ্ছেন।
সারাদেশে সর্বমোট ৩১ জেলায় কেউ মন্ত্রী হয়নি।