Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

নতুন বিনিময় ও সুদের হার অর্থনীতিকে দুর্বল করবে

সাব্বির আহমেদ। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে টাকার বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার দুটোই বাজার ভিত্তিক করে দিয়েছে। ডলারের বিনিময় মূল্য এক লাফে বাড়িয়েছে ৭ টাকা। সুদের হার এখন লাগাম ছাড়া। যার যার মতো সুদের হার নির্ধারণ করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। টাকার বিনিময় মূল্য ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এখন ডলার লেনদেন করছে নতুন নির্ধারিত ১১৭ টাকা দরে। নতুন বিনিময় হার ঘোষণার পরপরই খোলা বাজারে ডলারের দাম ১২৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। বৃহস্পতিবারে বাজারে ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাংকগুলো এবং মানিচেঞ্জারগুলো আরও বেশি দাম পাওয়ার আশায় লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে।

দেশের নামজাদা সব অর্থনীতিবিদরা এতদিন দুটো হারকেই বাজার ভিত্তিক করার কথা বলে এসেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক দেরিতে হলেও তাদের পরামর্শ মেনে নিয়েছে। সুদের হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজার ভিত্তিক করার পক্ষে যারা এতদিন বলে এসেছেন তারা খুব খুশি। কিন্তু এখন তারা বলছেন, আরও ছয় থেকে নয় মাস লেগে যাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট শুরু হয়েছিল তা জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দরের সঙ্গে খোলাবাজারের দরের মধ্যে ৭/৮ টাকা পার্থক্য দেখা গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রফতানি আয় এবং প্রবাস আয় দুই-ই বাড়তে শুরু করলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

বুধবারের বিনিময় হার পুনঃনির্ধারণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লেনদেন করেছে ১১০ টাকায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করেছে ১১৪-১১৫ টাকায়। খোলাবাজারেও ডলারের দর কাছাকাছি ছিল। কমে এসেছিল ফারাক। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন এবং একশ্রেণির কায়েমি স্বার্থবাধীদের অপপ্রচারের ফলে যে বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে এখান থেকে।

বুধবারের বিনিময় হার পুনঃনির্ধারণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লেনদেন করেছে ১১০ টাকায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করেছে ১১৪-১১৫ টাকায়। খোলাবাজারেও ডলারের দর কাছাকাছি ছিল। কমে এসেছিল ফারাক। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন এবং একশ্রেণির কায়েমি স্বার্থবাধীদের অপপ্রচারের ফলে যে বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে এখান থেকে।

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করেছিল ১১০.৫০ টাকায়। অর্থাৎ তখন এক দফা টাকার মান বাড়ানো হয়েছিল যা বাজারকে অস্থিতিশীল করেনি। কিন্তু এখন হঠাৎ করে একদিনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭ টাকা (৬.৩৬ শতাংশ) কমানোর কারণ পাওয়া যায়নি গণমাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ত ব্যাখ্যা দেয়নি। দিলে তা গণমাধ্যমে আসার কথা।

ফলে নতুন ঋণ না এসে শুধু পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে হওয়ায় মূলধন হিসাবে ঋণাত্বক স্থিতি তৈরি হয়েছে। সে ঋণও এখন বেশ কমে গিয়েছে। সরকারি ঋণের জন্য বড় কোনও পেমেন্ট নিকট ভবিষ্যতে করতে হবে না বলে জানানো হয়েছিল কিছু দিন আগেই। এমন সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে একদিনে টাকার মান ৬.৩৬ শতাংশ কমানোর মানে কি? কার স্বার্থে এতবড় দর পতন করা হলো?

ইউক্রেন-যুদ্ধ শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল যার ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে বহুলাংশে। ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৮৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০২২-২৩ সালে নেমে এসেছে ৭৫ বিলিয়ন ডলারে এবং চলতি অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ৪৪ বিলিয়ন ডলার যা বছর শেষে ৬৬ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। এই দুই বছরে রফতানি এবং প্রবাস আয় দুই-ই বেড়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভের খাতায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত ব্যালেন্স দেখিয়েছে; ঋণাত্বক ব্যালেন্স দিয়েছে শুধু মূলধন হিসাব। এ সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই বেশ মোটা অংকের ঋণ শোধ করতে হয়েছে বলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তাও মূলত বেসরকারি খাতের জন্য। ‘উপাস’ (UPAS) এলসির মাধ্যমে বেসরকারি খাত আগে যে ঋণ নিত বিশ্ব বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় তা আর লাভজনক নেই। ফলে নতুন ঋণ না এসে শুধু পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে হওয়ায় মূলধন হিসাবে ঋণাত্বক স্থিতি তৈরি হয়েছে। সে ঋণও এখন বেশ কমে গিয়েছে। সরকারি ঋণের জন্য বড় কোনও পেমেন্ট নিকট ভবিষ্যতে করতে হবে না বলে জানানো হয়েছিল কিছু দিন আগেই। এমন সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে একদিনে টাকার মান ৬.৩৬ শতাংশ কমানোর মানে কি? কার স্বার্থে এতবড় দর পতন করা হলো?

বিনিময় হার কত হলে তা প্রকৃত বাজার মূল্যের প্রতিফলন হবে? এমন প্রশ্নের জবাব নেই। কেউ বলতে পারে না এখন টাকার দাম কত হওয়া উচিৎ। এই যখন অবস্থা তখন টাকার দাম যতই কমানো হোক না কেন খোলা বাজারে ব্যাংকের থেকে দাম বেশি হবেই। খোলা বাজার ব্যাংকের থেকে বেশি দাম দিতে না পারলে তারা ডলার কিনতে পারবে না। তারা ডলার কিনতে না পারলে চোরাকারবারিরা হুণ্ডি করে টাকা পাচার করবে কী করে? ব্যাংকে টাকার দাম যতই কমানো হোক না কেন, যতদিন হুণ্ডি করার সুযোগ থাকবে ততদিন খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি থাকবে। এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দরকার নেই। দরকার হুণ্ডি নিয়ন্ত্রণ করা। হুণ্ডি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে। টাকার মান কমানোর শেষ নেই। এ চেষ্টা বৃথা তাই।

ডলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেও কমানো যাচ্ছিল না মূল্যস্ফীতি। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বেশ কিছুদিন ধরে মূল্যস্ফীতি আমাদের ঘাড়ে মামদো ভূতের মতো চেপে বসে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দুই পথঃ এক) সুদের হার বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে দরিদ্র করে, ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়; এবং দুই) বাজারে পণ্য ও সেবার সরবরাহ বাড়িয়ে পণ্যমূল্য কমিয়ে ফেলা যায়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে তা মানুষকে গরীব করে না বরং দেশকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করে তোলে।

খোলা বাজার ব্যাংকের থেকে বেশি দাম দিতে না পারলে তারা ডলার কিনতে পারবে না। তারা ডলার কিনতে না পারলে চোরাকারবারিরা হুণ্ডি করে টাকা পাচার করবে কী করে? ব্যাংকে টাকার দাম যতই কমানো হোক না কেন, যতদিন হুণ্ডি করার সুযোগ থাকবে ততদিন খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি থাকবে। এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দরকার নেই। দরকার হুণ্ডি নিয়ন্ত্রণ করা। হুণ্ডি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে। টাকার মান কমানোর শেষ নেই। এ চেষ্টা বৃথা তাই।

জানুয়ারি মাসে নতুন সরকার গঠনের পর সরকারের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের দেখেছি পণ্য সরবরাহ সহজ করা এবং সিণ্ডিকেট ও চাঁদাবাজি দমন করার পথে এগিয়ে যেতে। তার ফলও বাজারে দেখেছি। রোজা ও ঈদের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা এবার বাড়তি দাম নেবার সুযোগ কম পেয়েছে। গত কয়েক মাসে সামান্য করে হলেও মূল্যস্ফীতি কমে আসছিল। মূল্য নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম অর্থাৎ উৎপাদন এবং সাবলীল সরবরাহ আর কিছুটা জোরের সঙ্গে এগিয়ে নিলে নিয়ন্ত্রণে চলে আসত মূল্যস্ফীতি। এমন পরিস্থিতিতে কেন বাড়াতে হলো সুদের হার?

সুদের হার পণ্য সরবরাহ বাড়াতে পারে না; বাড়ায় উৎপাদন খরচ। কৃষি, শিল্প এবং সেবার উৎপাদন খরচ বাড়লে বাড়ে পণ্য ও সেবার দাম, কমে উৎপাদন, হয় মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশের মতো উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে সুদের হার বাড়িয়ে দিলে, উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি কিছু কমবে বটে তবে তা আবার বাড়িয়ে দেবে কমে যাওয়া টাকার মান। ডলারের বাড়তি দাম এবং ঋণের বাড়তি সুদ নিশ্চিতভাবে আরেক ধাপ বাড়াবে মূল্যস্ফীতি। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ব্যাংকগুলো। তারপর রফতানিকারকেরা ও প্রবাসী আয় গ্রহণকারীরা। ব্যবসা কমে যাবে আমদানীকারকদের।

মূল্যস্ফীতি কমানোর উত্তম উপায় হচ্ছে উৎপাদন বাড়িয়ে এবং সাপ্লাই চেইন সহজ করে সরবরাহ বাড়ানো। কাজটা কঠিন বটে। অসম্ভব নয়। অনেকগুলো পক্ষকে একত্রিত করে কাজটা করতে হয়। সুদের হার বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিণতি ভালো হয় না। এখনই উদ্যোগ না নিলে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদী সংকটের দিকে চলে যেতে পারে।

অর্থনীতির সাধারণ নিয়মানুসারে, মুদ্রার বিনিময় হার বাড়লে রফতানি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাস আয় স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি গতিতে বাড়ার কথা। বিশ্বব্যাপী চলছে যুদ্ধ এবং মন্দাবস্থা। ইউক্রেন-যুদ্ধ শুরু হবার পর টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩৬%। রফতানি ও প্রবাস আয় খুব একটা বাড়েনি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনীতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে বাড়তি রফতানি এবং প্রবাস আয় আশা করা কঠিন।

মূল্যস্ফীতি কমানোর উত্তম উপায় হচ্ছে উৎপাদন বাড়িয়ে এবং সাপ্লাই চেইন সহজ করে সরবরাহ বাড়ানো। কাজটা কঠিন বটে। অসম্ভব নয়। অনেকগুলো পক্ষকে একত্রিত করে কাজটা করতে হয়। সুদের হার বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিণতি ভালো হয় না। এখনই উদ্যোগ না নিলে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদী সংকটের দিকে চলে যেতে পারে।

লেখক: চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
ইমেইল: sabbahmed@yahoo.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত