রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থানায় আগুন, হামলা, ভাঙচুর ও হত্যাসহ নানা সহিংসতার মধ্যে কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের কাজে ফিরতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে দেশের সব পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনস, দপ্তর, পিওএম ও ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন নবনিযুক্ত আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
বুধবার পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ নির্দেশ দেন তিনি।
সংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিওএম, এপিবিএনস, সকল মেট্রোপলিটন এবং জেলা পুলিশ লাইনসসহ বিশেষায়িত সব পুলিশ ইউনিটের সব অফিসার এবং ফোর্সকে আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও জেলার পুলিশ সুপারদের নিজ নিজ থানা এলাকায় জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।
“আমরা জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি বর্ণিত কমিটি থানা ও থানা এলাকার নিরাপত্তা বিধানে আপৎকালীন সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবে এবং পরবর্তীতে এর চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবেলা করতে গিয়ে আন্দোলনকারী ও বিক্ষুব্ধ জনতার মুখোমুখি দাঁড়ায় পুলিশ। বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিনা কারণে গুলি ছুড়ে নিরীহ মানুষ ও শিশু হত্যার অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার পাশাপাশি হত্যা করা হয় অনেক পুলিশ সদস্যকে। এ অবস্থায় কর্মস্থল ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের থানাগুলো এখনও পুলিশহীন অবস্থায় রয়েছে।
এ অবস্থায় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব মেট্রোপলিটন, জেলা, নৌ, রেলওয়ে ও হাইওয়ে থানার অফিসার ও ফোর্সকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনসে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আইজিপি বলেন, “আমি পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সকল স্তরের সহকর্মীকে সামাজিক মাধ্যমে কোনও প্রকার ব্যক্তিগত, সমিতি, ব্যাচ, অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে কোন দাবি, মন্তব্য, প্রতিউত্তর প্রদানে বিরত থাকার নির্দেশ দিচ্ছি।”
বিশেষ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হতে হয়েছে জানিয়ে নতুন আইজিপি বলেন, “আমরা এখন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। এই আন্দোলনে ছাত্র, সাধারণ মানুষ, পুলিশসহ অনেকে শহীদ হয়েছেন। আমি প্রত্যেক বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।”
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ‘যৌক্তিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এজন্য বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা এখন থেকে আমাদের উপর অর্পিত আইনি সব দায়িত্ব পালনে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
সাম্প্রতিক আন্দোলন ঘিরে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন আইজিপি। তিনি বলেন, “দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট রয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই রাষ্ট্রের মূল শক্তি। তাই, আমরা সবসময় জনগণের পাশে থেকে জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে বদ্ধ পরিকর।”
পুলিশের কিছু উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার আচরণ, কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নেতৃত্বের ব্যর্থতায় অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন আইজিপি। তবে এই মুহূর্তে দেশের প্রয়োজনে নিজের দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করতে সব পুলিশের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
পুলিশের জীবনমানের উন্নয়ন এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন।
চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসে বিক্ষোভ
নির্মমভাবে পুলিশ সদস্যদের হত্যা, থানায় আগুন দেওয়া ও হামলাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন চট্টগ্রামের মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা।
বুধবার চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনসে সাদা পোশাকের অন্তত ২০০ পুলিশ সদস্য বিক্ষোভে অংশ নেন।
গত দু’দিনের সহিংসতায় চট্টগ্রাম শহরের ছয়টি থানা পুড়ে গেছে, অস্ত্র-গুলি লুট হয়েছে। থানাগুলোয় কাজ চালানোর মতো অবস্থাও নেই।
এরই মধ্যে নগরীর বিভিন্ন থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা ‘অধঃস্তন পুলিশ সংস্কার প্ল্যাটফর্মের’ ব্যানারে দামপাড়া পুলিশ লাইনসে গিয়ে বিক্ষোভ করেন।
নিজেদের বক্তব্যে আগুনের ভেতর থেকে বেঁচে যাওয়ার বর্ণনা দেন, অনেকেই নিহত সহকর্মীদের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কাঁদেন।
থানাগুলো যখন আক্রান্ত হচ্ছিল তখন শীর্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত দাবি জানানো হয়। সেখানে থানায় হামলাকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা, পুলিশ হত্যাকারীদের দ্রুত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা, আহত-নিহতদের পরিবারগুলোকে এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আজীবন রেশন-পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবারের এক সদস্যকে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতারও দাবি তোলেন তারা।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আ স ম মাহতাব মিঞা নিজের বক্তব্যে বলেন, “পুলিশ সদস্যরা যেসব দাবি জানিয়েছেন তার প্রত্যেকটি যৌক্তিক। আলাদা পুলিশ কমিশনের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। আমরা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে কাজ করতে চাই। পুলিশ মরতে চায় দেশের জন্য বিজয়ীর বেশে। আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই হত্যার শিকার হয়েছি।”
এই মুহূর্তে দেশে পুলিশের চেইন অব কমান্ড আছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কোনও চেইন অব কমান্ড নেই। চেইন অব কমান্ড থাকলে এত মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো না।”