প্রথম কার্যদিবসে নতুন মন্ত্রীদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক চাপ, দুর্নীতি দমন ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। নিজ নিজ মন্ত্রণালয়কে আরও এগিয়ে নিতেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা।
দ্বাদশ সংসদের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয় গত বৃহস্পতিবার। এরপর শুক্র-শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি পেরিয়ে রবিবার ছিল তাদের প্রথম কর্মদিবস। তাদের অভিনন্দন জানাতে সচিবালয়ের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ঘিরে ছিল মানুষের ভিড়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও কথা বলেন অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে।
সামন্ত লাল সেন
আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে তিনি বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীভাবে ভালো চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাবে মন্ত্রণালয়। ঢাকায় রোগীর চাপ কমাতে হবে। সেজন্য স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি হাসপাতালে যাবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে করে সব হাসপাতালের সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে। সমস্যা জেনে তবে সমাধানে পরিকল্পনা করা হবে।
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হবে। কোনও সমস্যায় পড়লে প্রধানমন্ত্রী ফোন করতে বলেছেন। নতুন দায়িত্ব নিয়ে কোনও সমস্যায় পড়লে আমি তার সঙ্গেই কথা বলবো।
সাবের হোসেন চৌধুরী
মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রতি দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ এবং পাহাড় কাটা রোধে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
টেকসই উন্নয়ন, বন দখল রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন পরিবেশমন্ত্রী। তিনি বলেন, পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে পারফর্মেন্সের দিক দিয়ে এক নম্বরে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। দায়িত্ব পালনে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি করা বা তদবির গ্রহণযোগ্য হবে না। আন্তর্জাতিক অর্থছাড়ের চেষ্টা করা হবে।
মো. আব্দুর রহমান
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ বাড়িয়ে তা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সুন্দর জীবনযাপনে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রণালয় এখন যেখানে আছে তা থেকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং এখান থেকে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করার দিকে আমাদের দৃষ্টি থাকবে। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন মন্ত্রী।
বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়ার প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের কাছে আমিষ সহজলভ্য করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে রমজান মাস সামনে রেখে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ন্যায্যমূল্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রির প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে। চেষ্টা থাকবে যেন এসব পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে এবং পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে কর্মকর্তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
তিনি জানান, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সরকারের প্রধান লক্ষ্য। কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে জনসেবা করার জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তা কর্মচারীর প্রতি অনুরোধও জানান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন যথাযথ মেনে চলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
মুহাম্মদ ফারুক খান
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, আমার কাজ হবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজগুলো সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রী সেবা ও লাগেজ হ্যান্ডেলিং মান আরো উন্নত করা এবং নতুন নতুন লাভজনক গন্তব্যে বিমানের রুট চালু করা।
বাংলাদেশ পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ উল্লেখ করে ফারুক খান বলেন, পর্যটনের এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দেশে নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করতে কাজ করব। পর্যটন শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নে বেসরকারি খাতে অনেক কাজ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ খাত এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
পাটখাতের সমৃদ্ধি অর্জনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মন্ত্রী বলেন, রপ্তানি পণ্য হিসেবে শুধুমাত্র গার্মেন্টস পণ্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে বহুমুখী পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে গার্মেন্টস শিল্পের মতো চামড়া শিল্পেও প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আশুগঞ্জে পুরাতন সার কারখানার জায়গায় একটি আধুনিক সার কারখানা এবং ভোলায় আর একটি নতুন সার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
রবিবার মতিঝিলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা ও মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
তিনি বলেন, তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নে শিল্প মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর/সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। আমরা চিনিকলগুলো আধুনিকায়ন করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই। লবণ শিল্পের উন্নয়নে কক্সবাজারে একটি লবণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে কাজ করব।
মোহাম্মদ এ আরাফাত
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করে কোনও গোষ্ঠী অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করলে সেটি গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত বলেছেন, এ ধরনের অপতৎপরতাকে জবাবদিহির আওতায় আনা নিশ্চিত করা হবে।
প্রতিমন্ত্রী আরাফাত বলেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী যে অপপ্রচার হচ্ছে সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতে কাজ করতে চাই। আমার পূর্বসূরী মন্ত্রীর কাছ থেকেও আমরা পরামর্শ নেব।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
দায়িত্ব গ্রহণ শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। এই বাক্য মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছে। ৭ই জানুয়ারি ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ইশতেহার জনগণের ইশতেহারে পরিণত হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের।
জুনাইদ আহমেদ পলক
টেলিকম খাতের লোকসানি কোম্পানিগুলোকে আগামী ৩০জুনের মধ্যে লাভজনক অবস্থায় উত্তোরণের উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ৪টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত – স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সোসাইটি। গত মেয়াদে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তৈরি করেছি। এই মেয়াদে আমাদের চ্যালেঞ্জ দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে ৪টি স্তম্ভের অধীনে সবগুলো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
এর আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের নেতৃত্বে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং এর অধীন দপ্তর ও সংস্থার পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছার পরিবর্তে প্রতিমন্ত্রীকে অভিনন্দনপত্র দিয়ে শুভেচ্ছা। কৃচ্ছতা সাধনে সরকারি নীতির সঙ্গে বিষয়টি খুবই মানানসই হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনিও এসময় নিজের লেখা দুটি বই উপহার দেন।
সিমিন হোসেন রিমি
কাউকে পেছনে ফেলে অগ্রসর হওয়া যায় না বলে উল্লেখ করেছেন নবনিযুক্ত মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি। দায়িত্ব গ্রহণের পরে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কাজ করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, কর্মপরিকল্পনা একটা থাকবে। কিন্তু তা একশ দিন বা সে রকম কিছু না। এটি একটি চলমান কাজ।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, একা কিছু পরিবর্তন করা যায় না। এজন্য টিম ওয়ার্ক সবচেয়ে জরুরি। শিশুদের বিকাশে কাজ করতে হবে। শিশুরা হয়রানি ও বুলিং এর শিকার হচ্ছে। এছাড়া শিশুদের মোবাইল আসক্তি দূর করতে যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোষ্ঠীসহ সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে সবার সঙ্গে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাব।
আগামীতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এখন আর পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পার্বত্যবাসীদের সামনে এগিয়ে নিতে আমি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।