দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোকেন চালান ধরার পর এর সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্র শনাক্তের কথা জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
একইসঙ্গে চক্রের একাধিক দেশি-বিদেশি সদস্যকে গ্রেপ্তার, গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দের কথা জানিয়েছে ডিএনসি।
অধিদপ্তর বলছে, নামমাত্র গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে কোকেন চোরাচালান কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল চক্রটি, যার পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে চক্রের প্রধান শনাক্ত হলেও তিনি পালিয়েছেন ৯ মাস আগেই।
রবিবার তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ঢাকা মেট্রো উত্তর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসি মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ডগ স্কোয়াড ও ডিএনসির যৌথ অভিযানে প্রায় ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ নোমথানডাজো তাওয়েরা সোকো (৩৫) নামে আফ্রিকার মালাউইর এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। চালানটি দেশের ইতিহাসে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান। পরদিন উত্তরার এক হোটেল থেকে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মেদি আলি (৫৫) গ্রেপ্তার হন। এরপর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ডিএনসির একাধিক টিম নেটওয়ার্কটিকে আইনের আওতায় আনতে মাঠে নামে।
ডিএনসি মহাপরিচালক বলেন, সোকো ও মোহাম্মেদি আলিকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিজিটাল ডিভাইস ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কোকেন চোরাচালান চক্রের অন্যান্য সদস্যসহ হোতা নাইজেরিয়ার নাগরিক ডন ফ্রাংকি ওরফে জ্যাকব ফ্রাংকির নাম পাওয়া যায়। ডন ফ্রাংকি তাদের কমিউনিটিতে ‘বিগ বস’ নামে পরিচিত। তিনিই মূলত এই কোকেন সিন্ডিকেটের হোতা, মাস্টারমাইন্ড। নামমাত্র গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তিনি কোকেন চোরাচালান কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশ-নাইজেরিয়ান কমিউনিটির প্রেসিডেন্টও ডন ফ্রাংকি।
ডিএনসি মহাপরিচালক আরও বলেন, সোকো ও মোহাম্মেদি আলির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে চক্রের অন্যতম সদস্য ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েংকে (৪২) গ্রেপ্তার করা হয়। কোকেনের চালান বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছানোর সমন্বয়কারী এই কেলভিন। গত ২০ জানুয়ারি মোহাম্মেদি আলির সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন তিনি। ২৪ জানুয়ারি কোকেনের চালানটি ধরা পড়ার খবর পেয়ে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগের চেষ্টা করেন, তার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই ঘটনায় সাইফুল ইসলাম রনি (৩৪) নামে এক যুবককে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। চক্রটির হোতা ডন ফ্রাংকির বাংলাদেশি সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতেন রনি। মাদারীপুরের শিবচরের গোলাম ফারুকের ছেলে রনি একটি অ্যাগ্রো মেশিনারিজ কোম্পানির পরিচালক। ডন ফ্রাংকির সঙ্গে দুই বছর তার ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। রনির কাজ ছিল মাদক বহনকারীদের দেশে প্রবেশের প্রয়োজনীয় ইনভাইটেশন, হোটেল রিজার্ভেশন ও ভিসা প্রাপ্তির কাজ তদারকি। এজন্য তিনি মাসপেক্স লিমিটেড নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার প্রস্তুত করে ফ্রাংকির কাছে পাঠাতেন।
রনির মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইস বিশ্লেষণ করে একাধিক ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার ও ডন ফ্রাংকির সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে। রনির কাছে ডন ফ্রাংকির বারিধারায় অফিস-কাম বাসার ঠিকানা পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে সেখানে অভিযান চালিয়ে কোকেন চোরাচালান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পরিবহনে ব্যবহৃত বিভিন্ন লাগেজ পাওয়া যায়। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও বাড়ির মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ডন ফ্রাংকি ৯ মাস আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন।
মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, ডন ফ্রাংকির অবর্তমানে তার ম্যানেজার আসাদুজ্জামান আপেল (২৭) ওই বাসায় থেকে ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। আপেলকেও আটক করা হয়েছে। আপেল কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মো. মোতালেব সরকারের ছেলে। বারিধারা থেকে আটকের পর আপেল জানান, বাংলাদেশে কোকেনের চালান প্রবেশের পরে পুনঃপ্যাকেজিং, নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তার দায়িত্ব ছিল তার। আপেলের ডিজিটাল ডিভাইস বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত প্রমাণও পাওয়া গেছে।
ডিএনসি মহাপরিচালক বলেন, আপলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই চক্রের সক্রিয় সদস্য নাইজেরিয়ার দুই নাগরিকের তথ্য পাওয়া যায়। পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নাইজেরিয়ার নাগরিক ননসো ইজেমা পিটার ওরফে অস্কার (৩০) ও এনডুলে এবুকা স্ট্যানলি ওরফে পডোস্কিকে (৩১) গ্রেপ্তার করা হয়।
অস্কারকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ডন ফ্রাংকির ভাই হুইসলি বারিধারার বাসায় থেকে বাংলাদেশ থেকে কোকেন ট্রানজিটের বিষয়টি সমন্বয় করে। আর বাংলাদেশ থেকে কোকেন ট্রানজিটের কাজে সহায়তা করে পডস্কি। পডস্কি জানিয়েছেন, হুইসলি ২-৩ দিন আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন।