ঘরে পড়েছিল মা ও দুই মেয়ের মরদেহ। বাইরে গলা কাটা অবস্থায় পড়েছিলেন বাবা রাশিকুল হক বাবু মোল্লা, যাকে পরে উদ্ধার করে নেওয়া হয় হাসপাতালে।
শুক্রবার সকালের এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল– রাশিকুল তার স্ত্রী ও সন্তানদের শ্বাসরোধে হত্যার পর নিজে গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তবে শুক্রবার রাতে হাসপাতালে রাশিকুল জানান, তিনি স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করেননি। এতে মা ও দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধোঁয়াশা বাড়ছে।
নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের দারোয়ানী বন্দর বাজার এলাকায় রাশিকুলের বাড়ি থেকে শুক্রবার সকালে তার স্ত্রী তহুরা বেগম (৩৫) ও দুই শিশুকন্যা আয়েশা আক্তার (৮) ও জারিনের (৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাশিকুলকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় নিহত তহুরার ভাই আসাদুজ্জামান নূর আসাদ শুক্রবার রাতে আহত রাশিকুল হক মোল্লাকে (৪৫) আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। তবে শুক্রবার রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাশিকুল কাগজে লিখে জানান, তিনি স্ত্রী-সন্তানদের খুন করেননি। ঘরে ঢুকে তাদের মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা চালান।
এদিকে, রাশিকুলের এক প্রতিবেশী বলছেন, রাশিকুল দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছেন। পাবনা ও রংপুরে তিনি এ জন্য চিকিৎসকও দেখিয়েছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা নীলফামারী সদর থানার এএসআই জালাল উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রাশিকুল হক বাবু মোল্লা গলা কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তার শ্বাসনালীর অর্ধেকটা কেটে গেছে। তিনি কথা বলতে না পারলেও হাতে লিখে জানিয়েছেন, তিনি খুন করেননি। তিনি সকালে বাসায় ঢুকে স্ত্রী-সন্তানদের লাশ দেখতে পান বলে জানিয়েছেন। এজন্যই নাকি তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
রাশিকুলের প্রতিবেশী মুজাহিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাবু মোল্লার আপন বলতে আর কেউ নেই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছিলেন। পাবনা ও রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় উনি ডাক্তার দেখিয়েছেন। গতকাল (শুক্রবার) তিনি ইশারায় এবং কাগজে লিখে বলেছেন তিনি খুন করেননি। বাদবাকি আমরা কিছু বলতে পারছি না।”
রাশিকুলের ফুপাত ভাই রাজিব বলেন, “আমরা প্রথমদিকে মনে করেছিলাম, ভাই তার স্ত্রী-সন্তানদের মেরে ফেলেছে। কিন্তু রাতে বলেছে, সে তার স্ত্রী-সন্তানদের মারেনি। স্ত্রী-সন্তানদের লাশ দেখে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে।”
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান, গলা ও হেড নেক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার মোহাম্মদ আব্দুল আজিম বলেন, রাশিকুলের শ্বাসনালীর অর্ধেক কেটে গেছে। হাতের শিরা কাটারও চেষ্টা করেছিল। আমরা তার চিকিৎসা দিয়েছি। তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন।”
এর আগে শুক্রবার রাশিকুলের ছোট বোন সাথী আক্তার (২৭) সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভাই কিডনিজনিত রোগে ছয় মাস অসুস্থ ছিলেন। বৃহস্পতিবার ভাবির সাথে আমার কথা হয়। বলেছিলাম শুক্রবার যাব। শুক্রবার সকালে মোবাইল ফোনে খবর পাই ভাবি ও দুই ভাতিজি আর বেঁচে নেই, ভাইকে গলা কাটা অবস্থায় রংপুরে নেওয়া হয়েছে। এরপর ভাইয়ের বাড়িতে এসে লোকজনের কাছে শুনি, ভাবি ও তার দুই মেয়েকে হত্যার পর গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ভাই। সে কী কারণে এবং কেন এমন ঘটনা ঘটাল তার কোনও কূল-কিনারা পাচ্ছি না।”
রাশিকুলের চাচাত ভাই জাকির হোসেন মোল্লা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “(শুক্রবার) সকালে আমাকে একজন ফোন দিয়ে জানায় রাশিকুল ভাই অসুস্থ। খবর পেয়ে সাথে সাথে আমি চলে আসি। এসে দেখি ভাইকে ভ্যানে উঠানো হচ্ছে। এ সময় তার গলা দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। আমাদের আরেক চাচাত ভাইকে সাথে দিয়ে তাকে দ্রুত নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে রংপুরে নেওয়া হয়। ওদিকে ভাবি ও তাদের দুই মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে ঘরে গিয়ে দেখি বিছানায় মৃত অবস্থায় তারা পড়ে রয়েছে।”
রাশিকুর স’মিলের ব্যবসার পাশাপাশি রসুন, পাট, তামাকের ব্যবসা করতেন জানিয়ে জাকির বলেন, “এবার তিনি রসুন, পাট ও তামাকের ব্যবসায় প্রচুর লস করেছেন। পাশাপাশি ব্যাংকে ঋণ ছিল তার। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি রোগেও ভুগছিলেন। এসব কারণে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন। আমরা পরিবারের সদস্যরা তাকে বলেছিলাম, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অর্থের সংস্থান করে তার সব সমস্যার সমাধান করব। এরই মধ্যে এমন অঘটন ঘটল। পুরো সংসারটা শেষ হয়ে গেল।”
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম জানান, “প্রাথমিকভাবে মা ও দুই মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। তবে সেটা হত্যা কিনা তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। শুক্রবার রাতে ময়নাতদন্তের পর শনিবার সকালে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত তহুরার ভাই আসাদুজ্জামান নূর আসাদ শুক্রবার রাতে রাশিকুল হক মোল্লার নামে এজাহার দায়ের করেছেন।”