সড়ক দুর্ঘটনার আর কোনও তথ্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংস্থা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।
এর কারণ ব্যাখ্যায় নিসচার সীমাবদ্ধতা ও পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক জন্ম হওয়ায় কথা জানিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, “সরকার যেহেতু বিআরটিএর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছে, তাই আমি আমার সংগঠন থেকে আর এই তথ্য প্রকাশ করব না। আমাদের সেল চালু থাকবে নিজস্ব গবেষণার জন্য।”
সোমবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘সড়ক দুর্ঘটনার বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান নিয়ে’ সংবাদ সম্মেলনে করে এসব কথা জানান ইলিয়াস কাঞ্চন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “নিসচা ২০১২ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে, সেদিন থেকেই আমরা সরকার ও দেশবাসীকে জানিয়ে আসছি এই কাজটি আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে শুরু করেছি।
“সারাদেশে আমাদের যতগুলো শাখা রয়েছে তাদের দেওয়া তথ্য এবং পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংবাদ ও বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে আমরা এই তথ্য সংগ্রহ করতাম। সেইসঙ্গে বলেও আসছি এটা পর্যাপ্ত নয় এবং ডাটা সংগ্রহের জন্য এটা যথেষ্ট নয়।”
সেকেন্ডারি তথ্যের উপর ভিত্তি করে নিসচা পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, “২০১২ সাল থেকে ‘সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান’ ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরেছি।
“কিন্তু যখন দেখলাম আমাদের দেখাদেখি অনেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থপান করছে এবং নানা বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, তখন এ বছর এসে আমি ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান আর তুলে না ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “শুরু থেকে আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের কাছে একটি দাবি জানিয়ে এসেছি, এটি কোনও বেসরকারি সংগঠন বা কোনও ব্যক্তির পক্ষে প্রকৃত চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের একটি সার্বক্ষণিক মনিটরিং সেল এবং লোকবলের প্রয়োজন রয়েছে।
“এছাড়া প্রযুক্তিগত ডেভেলপমেন্টেরও দরকার রয়েছে—যা কোনও ব্যক্তি উদ্যোগে করা সম্ভব নয়। মোটকথা এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা অপরিহার্য। যদিও প্রতিবছর পুলিশ তাৎক্ষণিক মামলার ওপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট দিতো। সে রিপোর্ট আর আমাদের রিপোর্টের সঙ্গে ছিল বিস্তর ফারাক।”
পুলিশের রিপোর্ট নিসচা গ্রহণযোগ্য মনে করে না জানিয়ে এর ব্যাখা তুলে ধরেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “এই রিপোর্ট (পুলিশের) তৈরি করা হয় শুধুমাত্র মামলার ওপর ভিত্তি করে অর্থাৎ যে দুর্ঘটনার মামলা করা হতো, শুধুমাত্র সেই দুর্ঘটনার তথ্যই ওই রিপোর্টে থাকতো।
“অনেকক্ষেত্রে দেখা যেত নানা কারণে অনেক দুর্ঘটনার মামলা হতো না। যেমন আমার স্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি। পুলিশের রিপোর্টে তো সেটা ছিল না। আবার কোনও দুর্ঘটনায় আহত যারা হয় তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।”
“৩০ দিনের মধ্যে মারা গেলে সেই তথ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে বিবেচিত হবে। আমাদের দেশে সেটা পুলিশ উল্লেখ করে না। এ কারণে এই ডাটাটির কোনও গ্রহযোগ্যতা আছে বলে আমরা মনে করি না।”
তিনি বলেন,“আমাদের দেখাদেখি অনেক সংগঠন বাহবা কুড়াতে যখন দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিতে শুরু করে এবং একেকজনের ডাটায় একেক রকম তথ্য প্রকাশ হতে থাকে, তখন থেকেই বিতর্কের শুরু বলে মনে করি।
“কারণ, এসব সংগঠন কখনোই আমাদের মতো করে তাদের রিপোর্ট নিয়ে বলতে শুনিনি, এটাই যথেষ্ট বা সঠিক নয়। এটা একটা চিত্র মাত্র।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারাবিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’ এ বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ৩১৬ জনের। তবে পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন। পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে ওই বছর ৫ হাজার ৯৩ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৭৫ জন নিহত। আরও দুই একটি সংগঠনের তথ্যও এরচেয়ে অনেক বেশি।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে সেটিও প্রতিটি রিপোর্টের সঙ্গে মিলছে না। এতে করে দেখা যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সরকার, পুলিশ ও বিভিন্ন রিপোর্টে ভিন্নতা রয়েছে।
“আমরা মনে করি এতে করে জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের সকল তথ্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে।”
তিনি বলেন, “দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানের যে ধারা আমরা শুরু করি এবং টানা ১১ বছর চলমানও রাখি। কিন্তু ভাবনার জয়গায় আমরা কখনই স্থির হতে পারিনি। পারিনি বলেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হচ্ছে আমরা উপরে উল্লেখিত কারণে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করব না।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার যেহেতু বিআরটিএর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। আমি আমার সংগঠন থেকে আর এই তথ্য প্রকাশ করব না। আমাদের সেল চালু থাকবে নিজস্ব গবেষণার জন্য।
তবে বেসরকারি সব বিশেষজ্ঞদের সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সামিল করে শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠনের আহ্বান জানান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন “আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরার যে ধারা আমরা শুরু করেছি সরকার যদি আমাদের সাপোর্ট এবং আর্থিক বরাদ্দ দেয় তাহলে আমরাও সরকারের সঙ্গে এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারব।”